'বিচারপতি বিদ্রোহ' ভারতের গণতন্ত্রেরই সংকট

সংবাদ সম্মেলনে চার বিচারপতি
সংবাদ সম্মেলনে চার বিচারপতি

প্রধান বিচারপতির প্রতি আস্থার সংকট বিচার বিভাগীয় হলেও ভারতীয় গণতন্ত্রের গুণমান থেকে একে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের এক গভীরতর ভয়াবহ সংকট বা বিদ্যমান শাসন পদ্ধতির পচন প্রক্রিয়ার একটা নাটকীয়  বহিঃপ্রকাশ। কারুকাজ করা কার্পেটের নিচের ধুলা বেরিয়ে পড়েছে। এটা মূলত নির্বাহী বিভাগের অবিবেকী সংবেদনশীলতায় বিচার বিভাগের একটা আপসকামিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এ ঘটনা কমনওয়েলথজুড়ে একটা বার্তা দেবে; আর সেটা দরকারি ছিল।

কেউ বলছেন, বিদ্রোহী চার বিচারপতির পদত্যাগ করা উচিত। কারণ, তাঁরা রেওয়াজ ভেঙেছেন। প্রধান বিচারপতি যদি অভিশংসনযোগ্য অপরাধ করে থাকেন, তাহলে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লেখার পথ খোলা ছিল। কিন্তু বিদ্রোহীরা দাবি করেছেন, সব পথ যাচাই করেই তবে তাঁরা উপায়ন্তর না দেখে বিবেকের তাড়নায় জাতির সামনে সত্য প্রকাশ করেছেন। আটপৌরে সংবাদ সম্মেলন নয়, তাঁরা রীতিমতো বিচারকক্ষ থেকে বেরিয়ে জনতার মঞ্চে, গণ-আদালতে পৌরহিত্য করেছেন। কিন্তু এটা গ্রহণযোগ্য নয়, এটা কোনো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। এর যাতে কখনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেটাই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

লক্ষণীয় যে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বিরুদ্ধে জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির ঠিক পরের চার বিচারপতি বিদ্রোহ করেছেন। তাঁরা কলিজিয়ামের (প্রধান বিচারপতি ও পরের চার জ্যেষ্ঠ বিচারপতিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি) বাইরের কেউ নন, তাঁরা সবাই কংগ্রেস আমলে ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হয়েছেন। অন্যতম বিদ্রোহী বিচারক হলেন আসামের রঞ্জন গগৈ। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি আলতামাশ কবীর। কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘রঞ্জন গগৈকে সুপ্রিম কোর্টে আনতে “আমি” ভূমিকা রেখেছিলাম।’ এই ‘আমি’ ইঙ্গিতবহ যে, কলিজিয়ামের ওপর ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি বিরাট প্রভাব রাখতে পারেন। হয়তো এটা উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির বাইরে নয়। কিন্তু এই সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করার দিন এসে গেছে। কলিজিয়াম যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকে, তাহলে ‘বিতর্কিত’ বেঞ্চগুলো গঠনে প্রধান বিচারপতির একার সিদ্ধান্ত অগণতান্ত্রিক, এমনকি নৈতিক কি না, তা বিচার্য।    

আমাদের বিবেচনায় এই সংকটকে ঘিরে সব থেকে লক্ষণীয় বিষয় হলো, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ–সংশ্লিষ্ট একটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত। সিবিআই অভিযোগ এনেছিল যে অমিত শাহ গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকতে সোহরাবকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন এবং তা কার্যকর হয়। মুম্বাইয়ের জেলা জজ বি এইচ লয়া ২০১৪ সালে যখন সোহরাব হত্যায় অমিত শাহের কথিত জড়িত থাকা মামলার বিচার করছিলেন, তখন তিনি ‘হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া’ বন্ধ হয়ে মারা যান। কিন্তু তাঁর পরিবারের দাবি, মৃত্যুর অল্প কয়েক দিন আগে অমিতের সপক্ষে রায় দিতে ১০০ কোটি রুপি ঘুষের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এর দুই সপ্তাহ পরে তাঁর স্থানে আসা বিচারক অমিতকে খালাস দেন। পরবর্তী সময়ে এ ঘটনা নিয়ে জনস্বার্থে দায়ের করা একটি মামলা শুনানির দায়িত্ব প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র জ্যেষ্ঠ বিচারকদের মত অগ্রাহ্য করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ কুমার মিশ্রর বেঞ্চে দিয়েছিলেন। এই বিচারপতির সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। আঁচ পাই, ওই মামলার শুনানি প্রধান বিচারপতি তাঁর ‘পছন্দের বেঞ্চে’ পাঠানোয় সরকার সন্তুষ্ট হয়। এই ঘটনাসহ অন্য অনেক ঘটনার যোগফল এই বিস্ফোরণ, কিন্তু এই একটি ঘটনা বিদ্রোহের সলতেয় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলেই মনে করা হয়। এমনকি এক প্রশ্নের জবাবে চার ‘বিদ্রোহীর’ একজন বিচারপতি রঞ্জন গগৈ সংবাদ সম্মেলনে তা স্বীকারও করেছেন।

এই বিদ্রোহের একটি অনিবার্য রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। শীর্ষ আদালতে কার্যত দুটি ধারার মেরুকরণ স্পষ্ট। কিছুটা সংযম রক্ষা করে হলেও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত হয়ে গেছে। বিজেপি প্রধান বিচারপতির দিকে এবং রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে। সব থেকে বড় কথা, এ পর্যন্ত ভারতের শীর্ষ বার-বেঞ্চের মুখ্য অনুঘটকেরা বিদ্রোহীদের দ্বারা ইতিহাসের প্রথম সংবাদ সম্মেলনটি করা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও যেসব প্রশ্ন তাঁরা তুলেছেন, তার যৌক্তিকতা কেউ নাকচ করে দেননি।

প্রধান বিচারপতি বা বিদ্রোহী চার বিচারপতির নিজ নিজ যুক্তি যেমনই হোক, এ ঘটনা বিশ্বের এই অঞ্চলের বিচার বিভাগের ওপর জন–আস্থায় একটা সুদূরপ্রসারী চাপ তৈরি করবে। রাষ্ট্রের এই স্তম্ভটির শক্তির একমাত্র উৎস জনগণের আস্থা, আজ সেখানে একটি গহ্বর তৈরি হলো।

ভারতের এই সংকট থেকে বড় শিক্ষা নেওয়ার বিষয় হলো, বিচারক নিয়োগের ব্যবস্থা একান্তভাবে সরকারের কাছে থাকা যেমন বিপদ, তেমনি নিরঙ্কুশভাবে সুপ্রিম কোর্টের কাছে থাকাও বিপদ। রাষ্ট্রের কোনো একক বা দ্বৈত অঙ্গের কাছে ক্ষমতা রাখা যাবে না, যাতে স্বচ্ছতার ঘাটতি পড়ে। স্বয়ংক্রিয় জবাবদিহির ব্যবস্থা মার খায়। আসলে প্রধান বিচারপতির এককভাবে বেঞ্চ গঠন নিয়ে যে সংকট ভারতে দেখা দিয়েছে, সেটা কমনওয়েলথভুক্ত কিছু দেশে আমরা বহুকাল ধরে দেখেছি, সেখানেও স্বচ্ছতা আনা জরুরি। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা যদি ‘ফাস্ট অ্যামোং দ্য ইকুয়ালস’ নীতির ভিত্তিতে চলতে পারে, তাহলে প্রধান বিচারপতি ও তাঁর ২৪ সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট সভা কেন একই নীতিতে চলতে পারবেন না? 

১৯৯৮ সালে থার্ড জাজেস মামলায় ভারতের নির্বাহী বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও পরের চার জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কলিজিয়ামকে বরণ করেছিল। এই কলিজিয়াম যে মুখ থুবড়ে পড়ল, তার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টকেই নিতে হবে। কম যোগ্য কিংবা মধ্যম মানের বিচারক নিয়োগ নিয়ে বেশ জোরালো প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের উচিত হবে ব্রিটেনের নবগঠিত কমিশনের অনুসরণে একটি উন্মুক্ত শুনানিনির্ভর বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া চালু করার সুদূরপ্রসারী রূপকল্প ঘোষণা করা। বিচারকদের অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আসতে হবে। বিনম্র গোপনীয়তার যুগ ভেবেচিন্তে বাসি হতে দেওয়াই ভালো। 

গোপনীয়তানির্ভর ভারতীয় কলিজিয়াম তার একুশ বছর পূর্তিতে এক অভূতপূর্ব বিস্ময়কর বিপর্যয় দেখল। দৃশ্যত এখানে সরকারের কোনো কলকাঠি নেই। কিন্তু এটা সন্দেহ করার কারণ আছে যে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সরকারের কোনো স্বার্থরক্ষা থেকে উদ্ভূত কোনো কিছু বিচারের ঝরনাধারাকে দূষিত করেছে কি না।

মাত্র দুই বছর আগে বিচারপতি নিয়োগে বিজেপি ও কংগ্রেস এক অসাধারণ মতৈক্যে পৌঁছে সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী এনেছিল। এতে তারা বিচারপতি নিয়োগে সরকারের একটা ভূমিকা রাখার বিধান করেছিল। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ৪: ১ ভোটে তা নাকচ করেন। ওই মামলার রায়দানকারী পাঁচজনের মধ্যে এই বিদ্রোহে অংশ নেওয়া চারজনই রয়েছেন। বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফ, রঞ্জন গগৈ ও মদন বি লোকুর মাত্র দুই বছর আগে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠতম ও বিদ্রোহের নেতা বিচারপতি জাস্তির সঙ্গে একমত হতে পারেননি। অথচ সংবাদ সম্মেলনে জাস্তি ওই তিনজনকে নিয়েই বলেছেন, কলিজিয়ামের মধ্যে কী ঘটছে তা জাতির জানা উচিত।

এটা চমকপ্রদ যে বিদ্রোহের নেতা বিচারপতি জাস্তি চেলমেশ্বরই একমাত্র বিচারক, যিনি কলিজিয়াম প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় আইনবিদ প্রশান্ত ভূষণের মতো যাঁরা ৯৯তম সংবিধান সংশোধনী বাতিলের মধ্যে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ঝান্ডা’ উড়তে দেখছিলেন, তাঁদের এখন আত্মজিজ্ঞাসা দরকার।

২০১৫ সালের অক্টোবরে ৪:১ ভোটে ৯৯তম সংশোধনী বাতিল হয়। ভিন্নমত প্রদান করে চেলমেশ্বর যা লিখেছেন, তার যুক্তি নাকচ করা যাবে না। তিনি লেখেন, ১. বিচারক নিয়োগ–প্রক্রিয়ায় অবশ্যই স্বচ্ছতা থাকতে হবে। কার নাম প্রস্তাব করা হলো, কে করল, কেন করল, তার পূর্ববৃত্তান্ত কী, সেটা কলিজিয়াম কেন, নির্বাহী বা সংসদ যে-ই এসে বলুক না কেন, এটা শুধু আমরাই জানব, অন্য কেউ জানবে না, তাহলে তাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলা যাবে না। ২. সরকারের বক্তব্যের কোনো গুরুত্বই থাকবে না, সব অবস্থায় শুধু কলিজিয়ামের মত অগ্রগণ্য থাকবে, তা হতে পারবে না। এটা ক্ষমতার ভারসাম্য নীতিবিরোধী। তাঁর কথায়, বিচারক নিয়োগে বিচার বিভাগের মতের প্রাধান্য থাকবে, এই মত ‘প্রায়োগিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ’। ৩. সব থেকে ভয়ানক হলো, বিচারপতি নিয়োগের নথিপত্র সব প্রধান বিচারপতির জিম্মায় থাকে। এগুলো সাধারণ মানুষ দূরে থাক, সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারকও দেখতে পারেন না। তাঁর এই কটাক্ষ উপভোগ্য, যখন তিনি লেখেন, অন্য বিচারপতিরা তো আর প্রধান বিচারপতির মতো ভাগ্যবান নন।

অনেক কাল ভেবেছি, ভারতীয় লোকসভায় ৭০ বছর ধরে যাঁরা ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে’ ক্রমাগতভাবে নির্বাচিত হয়ে চলেছেন, ব্রিটেনের পুরোনো উপনিবেশগুলোতে যাঁরা সাংবিধানিক বিপর্যয়ে বাঁচতে অভ্যস্ত, তাই আমরা যাঁরা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ভারতকে সমীহ করি, তারা কখন ভুলে গেলাম একটি স্বীকৃত সাম্প্রদায়িক শক্তি কখন নন্দিত গণতান্ত্রিক শক্তি হয়ে গেছে, কারণ মানুষ তাদের ভোট দিয়েছেন। এ ঘটনা বিচার বিভাগীয় নয়, এটা গণতন্ত্রের গভীর অসুখের লক্ষণ।

এমন একটি রাষ্ট্র কল্পনা করা কঠিন, যেখানে সাংসদেরা অন্তর্গতভাবে বেশি দুর্বলভাবে গঠিত হবেন, কিন্তু সেই দুর্বলতার ঘাটতি বিচার বিভাগ পূরণ করে দেবেন। আমরা ভুয়া ধারণা পাচ্ছিলাম যে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অনির্বাচিত বিচারকদের গুণমান এতটাই বেশি যে তাঁরা নির্বাচিতদের যোগ্যতার ঘাটতি পূরণ করে চলেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে জনস্বার্থে মামলা খুব বেশি বেড়ে গিয়েছিল। যেসব দেশের রাজনীতিকেরা দুর্বল, তাঁরা সবল একটি বিচার বিভাগ আশা করেছেন। তাঁরা ভেবেছেন, নির্বাচিতদের শাসনের ঘাটতি, মানবাধিকারের ঘাটতি অনির্বাচিত বিচারকেরা পূরণ করে দেবেন। সেটা যে কিছুকাল চলে, কিন্তু কালোত্তীর্ণ হয় না, পা পিছলে যেতে পারে, সেটাই স্মরণ করিয়ে দিল ভারতের বিচারপতি বিদ্রোহ।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]