'যে আগুন জ্বলেছে, তা হঠাৎ নিভবে না'

‘এত হিংসা তো আমরা আগে দেখি নাই’
‘এত হিংসা তো আমরা আগে দেখি নাই’

দিনের বেলায় সরকার, রাতের বেলায় বিএনপি। দিনে রাজপথে সরকারপন্থীদের রাজকীয় মহড়া কিন্তু রাতের দখল আগুন, ককটেল, পেট্রলবোমা–ধরা হাতের। এই হাত কার, জানতে চায় মানুষ। দিনের আত্মবিশ্বাস রাত হলেই ফুরিয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট আমাদের জাতীয় আত্মবিশ্বাসের আর্তনাদেরই প্রতীক। রাজনীতির আগুন সেখানে গরিব মানুষের শরীরে ধ্বংসনামা লিখছে। এমন দশায় পড়েই ভুক্তভোগী কেউ বলে ওঠে, ‘যে দেশে জানের নিরাপত্তা নাই, সেইটা আর দেশ নাই।’
‘এই আগুন শেষমেশ কোথায় গিয়ে লাগে কে জানে?’ কথাটা শুনে লোকটার দিকে আবার তাকালাম। লুঙ্গির ওপর মলিন কোট চাপিয়ে বার্ন ইউনিটের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ‘সরকার ইচ্ছা করলে আগুন দেওয়া দমন করতে পারে। যে ক্ষমতায় থাকে সে সব পারে। করে না ক্যান, সেটাই রহস্য। বুঝেন কিছু?’ বোঝা সত্যিই কঠিন। লোকটির নাম খোরশেদ আলম। করেন ছোটখাটো ব্যবসা। তাঁর পাশে থম ধরে থাকা লোকটি, যাঁর নাম মো. হানিফ, যাঁর ছেলে নাজমুলের দেহের একাংশ পুড়ে গেছে, তিনি এতক্ষণে কথা বলে উঠলেন, ‘যদি আমি মইরা যাইতাম, আমার ভবিষ্যৎ ঠিক থাকত। বিদেশে রাজমিস্ত্রির কাজ কইরা তয় ছেলেরে কলেজে পর্যন্ত আনছি। সে তো দল করে না, হ্যারে পোড়াইল ক্যান?’
এঁরা এসেছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে। গত শুক্রবার রাতে যাত্রাবাড়ীতে আগুনে-পোড়া বাসটির পোড়া ২৮ যাত্রীর একজন এঁদের স্বজন। মো. হানিফকে বললাম, আপনার ছেলে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার জন্য কাকে দায়ী করেন?
‘সরকার-প্রশাসনই ভালো জানে কারা দোষী। আমরা তো বইয়া থাকবার পারুম না। রাস্তায় তো বারাইতেই হইব। সরকাররে দেখতে হইব, কোনো মায়ের কোল যাতে খালি না হয়।’
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘কী করণীয় উনিই ভালো বুঝবেন। দ্যাশের ক্ষতি না কইরা কীভাবে দুই দল বইসা সমঝোতা করতে পারে, সেইটা উনাকেই ভাবতে হইব। মীমাংসা ছাড়া কেমনে চলব দ্যাশ?’
খোরশেদ আলম যোগ করলেন তঁার সাথে, ‘এইবার রাজনীতিতে হিংসা ঢুইকা গেছে। এত হিংসা তো আমরা আগে দেখি নাই।’
মানুষ বোঝে, মানুষ হিসাব করে। সত্যিই রাজনীতিতে এত হিংসা বহুদিন দেখা যায়নি। এমন হিংসা দেখা যায় যুদ্ধ পরিস্থিতিতে। তখন ভালো-মন্দ দুই পক্ষই চরম হিংসার আশ্রয় নেয়। প্রতিপক্ষের পাশবিকতাকে ধ্বংস করার জন্য জেনেশুনে পাশবিক আক্রমণ করা শুরু করে নরম মনের মানুষও। বাংলাদেশে হিংসাত্মক রাজনীতি তার সমর্থকদেরও এই পরিমাণ হিংসাত্মক করে তুলেছে যে, পরস্পরের বিনাশের ইচ্ছা তাঁরা খোলামেলাভাবেই প্রকাশ করেন পাবলিক মতামতে, ফেসবুকে। ঘৃণা যখন রাজনীতির প্রধান জ্বালানি হয়ে ওঠে, তখন যুক্তি চোখ বন্ধ করে, নীতি অচল হয়। তেমনি মন্দকে ভালো আর ভালোকে মন্দ বলতে কসুর করে আমাদের জয়-জিন্দাবাদী ঝগড়াপুরী রাজনীতির অনুসারীরা। এবং কেউ দায় নেয় না, দায় দেয় অন্যের ঘাড়ে।
তবে এই ঘৃণারও শ্রেণি-ঠিকানা আছে। ওপরের তলার মানুষের মধ্যে যত ঘৃণা আর দলবাজি দেখা যায়, তলার মানুষদের ততটা পোষায় না। পোড়া সন্তানকে বার্ন ইউনিটে শুইয়ে রেখেও মো. হানিফ তাই বলতে পারেন, ‘আমি আর পার্টিগতভাবে ভোট দিব না। আমার ছেলেরেও দিতে দিব না। পার্টি করতে দিলে তো ওরে মাইরা ফেলবে। আগে দলরে ভোট দিছি, কিন্তু এখন আমি স্বতন্ত্র হয়ে গেছি। ইলেকশনে স্বতন্ত্র কাউরে পাইলে ভোট দিব, নইলে নাই।’
এর পরও কথা থাকে। মানুষের মনের কথা শুনতে চাওয়ার সাংবাদিকসুলভ আহ্লাদ যতই দেখাই না কেন, মনের কথা মনেই রাখেন অনেকে। অবরোধের দিনগুলোতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যেখানেই গেছি, দেখেছি মানুষ তঁার মনের কথা মনেই রেখে দিচ্ছেন। সংলাপে জড়াতে চাইছেন না অচেনা কারও সঙ্গে। রাজনৈতিক সহিংসতায় শুধু দেশটাই দুই পক্ষে ভাগ হয়ে যায়নি, হৃদয়ভাগও চলছে। মনের মধ্যে মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে, চুপ হয়ে যাচ্ছে। এ রকম অবস্থা যেন বড় কোনো বিস্ফোরণের আগের জননীরবতা। মানুষ ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে আবার চেপেও রাখছে সেই রাগ। তার কিছুটা প্রকাশ পেল হাজারীবাগের মো. ইউসুফের কথায়। বার্ন ইউনিটে ভুগতে থাকা দুই শিকার তাঁর পড়শি ও বড় ভাই।
দুই দলের কাকে দায়ী করেন জিজ্ঞেস করতেই মো. ইউসুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দোনোজনেরই দোষ। আমরা কোন দিকে যাব জানি না। বাসে আতঙ্ক নিয়া চলাফেরা করি। কখন কী ঘইট্যা যায়? তবে সরকারের উচিত বিরোধী দলের সাথে বসা।’ তাঁর সঙ্গী পুরান ঢাকার আরেক বাসিন্দা আলী আহম্মেদ। তাঁর কথার ঝাঁজ আরেকটু বেশি। তাঁর সোজা উত্তর, ‘রাষ্ট্র তো এই রকম চলে না। সরকার মানে না ক্যান? বসে না ক্যান? দুই দল আলোচনার মাধ্যমে ভাগাভাগি কইরা নিক!’
মো. ইউসুফের কথা তখনো শেষ হয়নি। তিনি বলে চলেন, ‘আমার ভাই পুড়ছে আগুনে, আমি পরিষ্কার করে জানতে চাই কারা দায়ী। সরকারের কাছেই জানতে চাই। তেনারা বলছেন দেখামাত্র গুলি করবেন। কারে গুলি করবেন? ওনারা জ্ঞানী মানুষ, গুলি কইরা মাইরা ফালাইলে বিচার করব কার? সাক্ষী দিব কে? বিচার চাই, মারামারি চাই না ভাই।’
রাজনীতি যখন ন্যায় নিখোঁজ, তখন ভাগাভাগিই বিকল্প নীতি। যখন ক্ষমতার ভাগাভাগির পথ বন্ধ হয়ে একচেটিয়া ক্ষমতা কায়েম হয়, তখন ক্ষমতাবঞ্চিতরা হাভাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেটাই কি ঘটছে না বাংলাদেশে?
এর মধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এসে ফিরে গেছেন। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে এলেন পুরান ঢাকার স্বতন্ত্র সাংসদ হাজি সেলিম। আওয়ামী লীগ করলেও গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে জয়ী হন। বার্ন ইউনিটের সামনের চত্বরে তাঁকে ঘিরে জটলা। সবাই কিছু শুনতে চায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা জনগণ যা শুনতে চায়, তা বলতে অক্ষম অথবা সেই উচিত কথাটি তাঁরা ভুলে গেছেন। হাজি সেলিমও অনেকক্ষণ ফটোসেশন করে পাঁচ ভ্যান ফল আর বিরিয়ানি পাঠালেন পোড়া রোগীদের জন্য। এটাই তাঁর অবদান।
ওদিকে ভিআইপি ও সাংবাদিকদের ভিড়ভাট্টা কমাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাইরে বক্তৃতার ডায়াস ও মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করেছে। তার সামনে ডজন খানেক টিভি-ক্যামেরার তেপায়া স্ট্যান্ড। রাজপথে মানুষ পোড়ার মহড়া, বার্ন ইউনিটের সামনে বক্তৃতা আর সহানুভূতি দেখানোর প্রদর্শনী। জনগণ নিয়ে রাজনীতি চলছে, চলবে।
জীবন চলছে, চলবে। রূপগঞ্জের নাজমুল গত শুক্রবার ঢাকায় আত্মীয়ের বিয়েতে এসেছিল পুরো পরিবারসহ। অন্যরা অন্য বাসে আগে চলে যায়, সে আসে পরে। হাজারীবাগের দুই ভায়রা ভাই মোজাফ্ফর মোল্লা ও শাহজাহান যাচ্ছিলেন প্রথম জনের ছেলের বিয়ের পাত্রী দেখতে। যুদ্ধের মধ্যেও মানুষকে পেটে ভাত দিতে হয়, সম্পর্ক করতে হয়, আয় করতে হয়, জীবন চালাতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেও এভাবেই সংসার-সম্পর্ক ও উৎপাদন চালিয়ে গিয়েছিলেন যাঁরা; তাঁরা আসলে সমাজটাকেই বাঁচিয়ে রাখছিলেন। এঁদের অবদানেই যুদ্ধের শেষে দ্রুত দেশটা আবার দাঁড়িয়ে চলা শুরু করতে পেরেছিল। আজ যাঁরা জীবিকার জন্য, সংসারের জন্য, পরস্পরের জন্য পথে নামছেন আর আগুন-গুলি-বোমার শিকার হচ্ছেন, তাঁরাও চরম ঝুঁকির মুখে দেশটাকেই চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যখন জীবনের বিরুদ্ধে রাজনীতি, অর্থনীতির বিরুদ্ধে ক্ষমতানীতি; তখন দেশ চলতে পারে না। প্রতিটি দশকে উত্থানের মুখে বলপ্রয়োগের রাজনীতির জন্য দেশ মুখ থুবড়ে পড়ে। পৃথিবী এগিয়ে যায়, আমরা চেয়ে দেখি।
এই ঢাকা শহরে একসময় জতুগৃহ নামে একটি বাস চলতে দেখতাম। কোনো নির্দয় রসিক অথবা জ্ঞানী মানুষ এই ভবিষ্যতের ভয়ে হয়তো সেই নাম দিয়েছিলেন। মহাভারতের কাহিনির পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী দুর্যোধনের ভয়ে জতুগৃহ নামে এক ঘরে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেটা আসলে ছিল ফাঁদ। মেঝে থেকে চাল পর্যন্ত পুরোটা মোড়া ছিল ঘি ও অন্যান্য দাহ্যবস্তু দিয়ে, যাতে ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে নিমেষে পুড়িয়ে মারা যায়। পাণ্ডবেরা টের পেয়ে সেই ঘরে পাঁচ সন্তানসহ এক আদিবাসী মাকে রেখে নিজেরা প্রাণে বাঁচেন। নিরীহ মানুষগুলো, যারা জানত না জতুগৃহ আশ্রয় নয়, দহনের ফাঁদ। বাংলাদেশের মানুষও বুঝতে পারছে না কোনটা ফাঁদ আর কোনটা আশ্রয়; তাই মরছে।
আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্তাকর্ত্রীরা দেশটাকেই জতুগৃহ বানিয়ে ফেলছেন। সাধারণ মানুষকে সে রকমই দহনমুখী পথে ঠেলে দিচ্ছেন। বাস-ট্রাকগুলো যে সহসা জতুগৃহ হয়ে উঠল তার রহস্য কী? আগুনে পোড়া মানুষের সেই স্বজনের কথাটা তাই ভোলার নয়, ‘এই আগুন শেষমেশ কোথায় গিয়ে লাগে কে জানে?’। গায়ক-কবি কফিল আহমেদের গানের কথাই যেন তিনি প্রতিধ্বনি করলেন, ‘যে আগুন জ্বলেছে, তা হঠাৎ নিভবে না।’
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]