'শরণার্থীদের স্বাগত'

আমি এইমাত্র কিছু বিরক্তিকর শরণার্থীর গোপন আস্তানা থেকে ফিরলাম, যাদের কারণে ট্রাম্পের রাগ চড়ে যাবে। ওল্ড ক্যানেলে তাদের সেই বাড়িতে যে আমি এই প্রথম গেলাম, তা নয়। তারা এক বিপজ্জনক দেশ থেকে পালিয়ে এসেছিল, যেখানে চরমপন্থীরা গিজগিজ করত। আর তারা ‘অর্থনৈতিক কারণে’ নিজেদের জন্য প্রথম নতুন বাড়ি খুঁজেছিল।

আরও খারাপ ব্যাপার হচ্ছে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্যাপারটা হচ্ছে, নিজ দেশ ছাড়ার জন্য যথেষ্ট কারণ থাকলেও ‘আমেরিকা’কে আশ্রয় ভাবার কারণ তাদের ছিল না।
না, তারা কিন্তু সিরীয়, আফগান, তুর্কি বা ইয়াজিদি নয়। পরিবারের ছোট মেয়েটি যদিও ‘ফিলিস্তিন’ নিয়ে একটি বই পড়ছিল এবং ছিল এক নির্যাতিত জাতির সদস্য। এ মেয়েটি আর কেউ নয়, জার্মান ইহুদি মেয়ে আনা ফ্রাঙ্ক। সে আর তার পরিবার নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ১৯৩৩ সালে হল্যান্ডের আশ্রয় পেয়েছিল। এরপর জার্মানি হল্যান্ডও দখল করে নিলে সে দেখল, আবারও সে তার নিজ দেশ জার্মানির বিষাক্ত শাসনের কবলে পড়েছে। এরপর তার বাবা যখন বুঝলেন, ইহুদিরা জার্মানির মতো হল্যান্ডেও কতল হবে, তখন ১৯৪১ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রয় চান। কিন্তু তাঁদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
হ্যাঁ, আমি ভাবছি, ট্রাম্প প্রশাসন তখন কী করতে পারত।
আনা ফ্রাঙ্কের এ ডায়েরিটিই প্রথম বই, মা চেয়েছিলেন যেটি আমি ‘নিজে নিজেই’ পড়ি। শিশু থেকে বড় হওয়ার সুন্দর এক গল্প, যে গল্প ভয়ের ও ভালোবাসার এবং আনন্দ ও আতঙ্কের। সারা জীবনের জন্য এই গল্প আমার মনে আসন করে নেয়। বইটি আরবিসহ ৭০টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আমস্টারডামে শরণার্থীদের সেই গোপন আস্তানা এখন জাদুঘর। সেখানকার সরকারি কর্মকর্তা দুঃখের সঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, আরব জগতে এই বইয়ের মারাত্মক প্রাসঙ্গিকতা থাকা সত্ত্বেও গড়ে মাসে একটি আরবি অনুবাদ সেখান থেকে বিক্রি হয়েছে।
এই তীব্র, করুণ এবং এত প্রাসঙ্গিক আনা ফ্রাঙ্কের কাহিনিটা আজকের দুনিয়ায়! একই সঙ্গে প্রাসঙ্গিক তার মা, বড় বোনসহ আরও যারা ওই বাড়িটায় লুকিয়েছিল, তাদের কথাও। আর তারপর তো একদিন সেখানে গেস্টাপো বাহিনী এসে পড়ে।

>প্রতিবার যখন আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়ি, ততবারই নতুন কিছু পেয়ে যাই, যেটা আগের পড়ায় চোখে পড়েনি। পাঠক, এটি যদি পড়ে না থাকেন, তাহলে এখনই পড়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিন


ডাচ জাতি আনার প্রতি বেশি অনুগত হবে, মার্কিনদের চেয়ে। আনার বাবা অটো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার জন্য ম্যাসি’স ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিকের বন্ধুদের সহায়তা চেয়েছিলেন। তাঁর শ্বশুরবাড়ির পক্ষের দুই আত্মীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। তিনি স্ত্রী ও দুই কন্যার দুর্দশার কথা জানিয়ে তাঁদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগ্রহী ছিল না। এমনকি অটো কিউবার ভিসাও চেয়েছিলেন। ১৯৪১ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি তা পেয়েও যান, কিন্তু পার্ল হারবারের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তা বাতিল করা হয়। শরণার্থীদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্য নাৎসি জার্মািন তত দিনে জার্মান ইহুদিদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল। ফলে ফ্রাঙ্কের পরিবারসহ অন্য যারা হল্যান্ডে লুকিয়ে ছিল, তারা নিজ রাষ্ট্রের দখলদারির মধ্যে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে।
প্রতিবার যখন আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়ি, ততবারই নতুন কিছু পেয়ে যাই, যেটা আগের পড়ায় চোখে পড়েনি। পাঠক, এটি যদি পড়ে না থাকেন, তাহলে এখনই পড়ে ক্ষতি পুষিয়ে নিন। মেয়েটি লেখক হতে চেয়েছিল। সে এ ডায়েরিটিকে দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স নামের উপন্যাসে রূপ দিতে চেয়েছিল। ১৯৪৪ সালের ১১ মে সে লিখেছিল, ‘আমি একদিন সাংবাদিক হতে চাই, এটাই আমার সবচেয়ে বড় ইচ্ছা।’ এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
কিন্তু একদিন ডাচ নাৎসি দলের তিন লোক নিয়ে এল জার্মান এসএস বাহিনীর অফিসারদের। আমার কখনো কখনো মনে হয়, আনার এই পরিণতি যেন গ্রিক ট্র্যাজেডির অনিবার্যতার মতো। তার পরিবারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট। তবে আনার বাবা অটো বেঁচে যান। যুদ্ধের পর সোভিয়েত সেনাবাহিনী তাঁকে অসউইচ বধ্যভূমি থেকে উদ্ধার করে। মা এডিথও সেখানে মারা যান। মারগট ও আনা বারগেন-বেলসেনে অসুস্থ হয়ে মারা যান। তখন আনার বয়স ১৫ বছর। তার মৃত্যু হয় সবার শেষে।
বেলসেনে যে হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ গণকবরে ঠেসে ঢোকানো হয়েছিল, তাদের মধ্যে আনাও একজন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি নিজের জেটবিমানে চড়ে শিপল বিমানবন্দরে নেমে আমস্টারডামের ওই খালের ওপরের বাড়িতে যাবার সময় না–ও পান, আনার ডায়েরিটি তিনি অন্তত পড়ে নিতে পারেন। বইটি ছোট। এটা এক শিশুর বই, তাই পড়াও সহজ। এটা এক ইহুদি মেয়ের লেখা বই, যে একটা পর্যায়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে—কেন ঈশ্বর তার জাতির মানুষের জীবনে এমন ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হন? ঠিক যেভাবে আজকের শরণার্থীরা জানতে চায়, ঈশ্বর কেন তাদের পরিত্যাগ করেছেন?
লুকিয়ে থাকার ওই দুই বছরে চার ডাচ নাগরিক প্রতিদিন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আনার পরিবারকে সাহায্য করেছিলেন। পরে তাঁরা বলেছিলেন, স্বাভাবিকভাবে এমনটাই তো করার কথা। একদম বেমানান মানুষ তাঁরা। কারণ, আজকাল বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে ভাবানো হয়। আমার ধারণা, ট্রাম্প এমনটাই ভাবেন। তারপরও এ সপ্তাহে—ইতিমধ্যে যখন হাজার হাজার শরণার্থী ইউরোপে হাজির হয়েছে—আমি আনাদের লুকিয়ে থাকার ওই বাড়ির রাস্তায় গিয়েছিলাম। দেখলাম, সেখানকার ছোট্ট এক ক্যাফের মূল দরজায় ডাচ মালিক লিখে রেখেছেন, ‘শরণার্থীদের স্বাগত’।

দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।