এখনই উদ্যোগ না নিলে এবারও ডেঙ্গু থাবা বসাবে

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা অনেক।ছবি : প্রথম আলো

বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর কেবল মৌসুমি বা শহুরে রোগ নয়, এর বিস্তার ঘটেছে সারা দেশে এবং প্রায় সব মৌসুমেই। বাংলাদেশের ডেঙ্গু ডাইনামিক ড্যাশবোর্ডের (২০২৫) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৬ হাজার ৬৮২ জন। তবে প্রকৃত ভর্তি রোগীর সংখ্যা এর চেয়ে আরও বেশি হতে পারে। কারণ, দেশের সব হাসপাতালকে এখনো ডেটা রিপোর্টিং সিস্টেমের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

ওই ড্যাশবোর্ডে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরও ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি—১৪ হাজার ৩৬৪ জন, যা মোট আক্রান্ত রোগীর ৩৯ শতাংশ। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে বিবেচনা করলে বরিশাল বিভাগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই সংখ্যা ১১ হাজার ১৬০ ও সংখ্যাটি মোট আক্রান্ত রোগীর ৩০ শতাংশেরও বেশি। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৬০২ জন, রাজশাহীতে ২ হাজার ৬১৯, খুলনায় ১ হাজার ৮৯০, ময়মনসিংহে ৬৯৮, রংপুরে ২৪৫ ও সিলেটে ১০৪ জন।

মৃত্যুর পরিসংখ্যানে মাসভিত্তিক বিশ্লেষণ দেখায়, বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোট ২৩ জন মারা গেছেন। জুনে ১৯ জন, জুলাইয়ে ৪১, আগস্টে ৩৯ ও সেপ্টেম্বরের প্রথম ১১ দিনে ২৩ জন মারা গেছেন। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১৪৫ জন। এর মধ্যে ৬৯ জন, অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকই শিশু, কিশোর ও তরুণ। ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা মাত্র ১৪ জন, যা মোট মৃত্যুর মাত্র ১০ শতাংশেরও কম।

অর্থাৎ ডেঙ্গু সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে শিশু, তরুণ, কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল মানুষের। ডেঙ্গুর কারণে এই বয়সী মানুষের মৃত্যু শুধু পারিবারিক শোক নয়, এটি অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার ওপর সরাসরি আঘাত।

একজন কর্মক্ষম তরুণের মৃত্যু মানে তাঁর পরিবারের উপার্জনক্ষম হাতটি চিরতরে থেমে যাওয়া। একই সঙ্গে রাষ্ট্র হারাচ্ছে একজন সম্ভাবনাময় নাগরিককে, যিনি আয়, সঞ্চয়, ভোগ ও কর প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদান রাখতেন।

এভাবে ডেঙ্গুর অর্থনৈতিক বোঝা অন্যান্য অনেক রোগের তুলনায় বহুগুণ বেশি। গবেষণা বলছে, শুধু চিকিৎসা খরচ নয়, অকালমৃত্যুজনিত ক্ষতিও দেশের জিডিপিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তাহলে প্রশ্ন আসে, এত মৃত্যুর পরও কেন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো নড়েচড়ে বসছে না? স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত মানুষের পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে, কিন্তু এর বাইরে কার্যকর কোনো নীতি-উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝেমধ্যে ফগার মেশিনে কীটনাশক ছিটিয়ে দায় সারছে। অথচ গবেষণা বলছে, এ ধরনের ফগিংয়ে আসলে ডেঙ্গুর মূল বাহক এডিস মশা দমন হয় না।

হাসপাতালগুলোয় শয্যাসংকট, ডাক্তার-নার্সের ওপর অতিরিক্ত চাপ ও পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহের অভাব ডেঙ্গুর চিকিৎসাব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে তুলছে। প্রশাসনিকভাবে দায়সারা কাজ হচ্ছে, কিন্তু সুসংগঠিত ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা অনুপস্থিত।

ডেঙ্গু শুধু একটি রোগ নয়, এটি আমাদের অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার প্রতিচ্ছবি। আমরা যদি এখনো হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে মৃত্যু আরও বাড়বে, পরিবারগুলো ভাঙবে, সমাজ ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়বে। এখনো সময় আছে আমাদের বিবেক ও চেতনা জাগ্রত করার।

আমরা সাধারণ নাগরিকেরাও দায় এড়াতে পারি না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ে পোস্ট দিই, মৃত ব্যক্তিদের ছবি বা সংবাদ শেয়ার করি, কিছুক্ষণ দুঃখ প্রকাশ করি, তারপর আবার আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই। এর বাইরে আমাদের সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে।

আমরা যেন ধরেই নিয়েছি, এটি নিয়তি, যা ঘটার তা–ই ঘটবে। এ ভাবনা একধরনের কর্তব্য ও দায়িত্বে উদাসীনতার মানসিকতা তৈরি করছে, যা আমাদের নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। ফলে আমরা ভাবি–ই না যে আগামীকাল আমাদের সন্তানেরা, আমাদের পরিবার কিংবা আমরাই হয়তো এ মৃত্যুর শিকার হব।

আমরা কি একবারও ভেবেছি, যেসব শিশু তাদের মা বা বাবাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে যাচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? যেসব পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারাচ্ছে, তাদের জীবন কেমন হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

ডেঙ্গু কেবল একটি স্বাস্থ্যসংকট নয়, এটি এক ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়, যা পরিবারের কাঠামোকে ভেঙে দিচ্ছে, শিশুদের শিক্ষা ও নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

ডেঙ্গুর এই তীব্রতা হঠাৎ আসেনি। এটি আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার সম্মিলিত ফল। আমরা ব্যক্তি হিসেবে নিজের বাড়ি ও আশপাশ পরিষ্কার রাখি না। পরিবারে শিশুদের সচেতন করি না।

সমাজ হিসেবে আমরা সম্মিলিত উদ্যোগ নিই না। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্ব এড়িয়ে চলে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতির অভাব, দুর্বল সমন্বয় ও পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের ঘাটতি স্পষ্ট। অতএব, দায় একক কারও নয়, দায় আমাদের সবার।

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কমাতে হলে এখনই সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে নেতৃত্ব দিতে হবে ওয়ার্ডভিত্তিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও কার্যকর মশা নিধন কর্মসূচির মাধ্যমে। মশা নিধন কর্মসূচি সফল করতে হলে এর পুরো ইকোসিস্টেমকে সম্পূর্ণ কার্যকর করে তুলতে হবে। এ জন্য কিছু মৌলিক দিক নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।

প্রথমত, যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তা মশার মধ্যে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করেছে কি না, তা নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ওষুধের সঠিক অনুপাতে মিশ্রণ নিশ্চিত করা ও বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকর পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা অপরিহার্য, যেমন কখন অ্যাডাল্টিসাইড ও কখন লার্ভিসাইড ব্যবহার করতে হবে, তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

একই সঙ্গে মশকনিধন কর্মীদের জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তাঁরা ওষুধের সঠিক প্রয়োগ সম্পর্কে দক্ষ হয়ে ওঠেন। কর্মীদের কাজে মনোযোগী ও উৎসাহী করতে ইন্ডিকেটরভিত্তিক পারফরম্যান্স পুরস্কার চালুর বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে।

কার্যক্রমের ফলাফল কতটা কার্যকর হচ্ছে, তা স্বচ্ছ ও নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা শক্তিশালী করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে মহল্লা বা ওয়ার্ডভিত্তিক সামাজিক পর্যবেক্ষণ চালু করা যেতে পারে, অর্থাৎ প্রতিটি মহল্লা থেকে একজন বা একাধিক ব্যক্তির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা, যেখানে তারা নিশ্চিত করবেন নির্ধারিত সময়ে মশকনিধন কর্মীরা ওষুধ ছিটিয়েছেন কি না। সর্বোপরি, ডেটাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি কার্যকর ও শক্তিশালী সার্ভেল্যান্স সিস্টেম গড়ে তোলা অপরিহার্য।

এর পাশাপাশি কমিউনিটি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিটি স্কুলে ‘ওয়েলবিয়িং ক্লাব’ গঠন করে সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের ডেঙ্গু প্রতিরোধসহ বিভিন্ন সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণমূলক বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে। একইভাবে রোভার স্কাউট, গার্লস গাইড, খুদে ডাক্তার কর্মসূচি ও অন্যান্য যুব সংগঠনকে ডেঙ্গু প্রতিরোধবিষয়ক কার্যক্রম ও আলোচনার সঙ্গে যুক্ত করলে এর সামাজিক প্রভাব বহুগুণে বেড়ে যাবে।

এখানে সামাজিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে এবং মসজিদ, স্কুল, ক্লাব ও এনজিওগুলোকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল হতে হবে—বাড়ির ছাদ, উঠান, ফুলের টব, ড্রেন ও যেখানে পানি জমে থাকে, সেসব স্থান নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।

অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত নীতি প্রণয়ন, পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ, গবেষণা কার্যক্রম জোরদার এবং হাসপাতাল ও ল্যাবসুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সর্বোপরি গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধারাবাহিক প্রচারণা চালিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো অপরিহার্য।

ডেঙ্গু শুধু একটি রোগ নয়, এটি আমাদের অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার প্রতিচ্ছবি। আমরা যদি এখনো হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে মৃত্যু আরও বাড়বে, পরিবারগুলো ভাঙবে, সমাজ ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়বে। এখনো সময় আছে আমাদের বিবেক ও চেতনা জাগ্রত করার।

আসুন, সম্মিলিত উদ্যোগে, নিজ নিজ এলাকার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের (সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ বা ইউনিয়ন পরিষদের) নেতৃত্বে এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে একটি টেকসই ও কার্যকর সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি।

সৈয়দ আবদুল হামিদ অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি) ও নেটওয়ার্ক ফর হেলথ কেয়ার এক্সেলেন্স (এনএইচই); এবং প্রধান উপদেষ্টা, ইউনিভার্সাল রিসার্চ কেয়ার লিমিটেড।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)