রাজকুমারী গুলবদন বেগম: মোগল ইতিহাসের নারীবাদী বয়ান 

মোগল সম্রাটের মেয়ে, বোন ও ফুফু গুলবদন বেগম বাদশাহ আকবরের নির্দেশে সাম্রাজ্যের ইতিহাস লিখতে শুরু করেছিলেন। শেষ করতে পারেননি। তাঁর সেই অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি মোগল সাম্রাজ্যের অজানা নানাদিকে আলো ফেলে। বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ইতিহাসবিদ রুবি লাল বলেছেন, গুলবদনের সেই অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিই জানান দেয় ইতিহাসের নারীবাদী বয়ান কেন জরুরি। 

রুবি লালের লেখা ভ্যাগাবন্ড প্রিন্সেস: দ্য গ্রেট অ্যাডভেঞ্চার্স অব গুলবদন বইয়ের প্রচ্ছদ

২০০১ সালের কথা। ‘মোগল ইন্ডিয়া’ নিয়ে চার বছর ঘাম ঝরিয়ে স্নাতক শেষ করেছি কেবল। এবার আমার কাজ জনস হপকিনসের জন্য ‘উইমেন, জেন্ডার অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটি’ নিয়ে একটা প্রোগ্রাম তৈরি করা। প্রথম দিন। জনস হপকিনসের গিলম্যান হলের সামনে আমি কফির জন্য অপেক্ষা করছি। এক খ্যাতনামা পুরুষ ইতিহাসবিদ ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে অভিনন্দন জানালেন। এর পরেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘এখন বলুন, আমাদের এখানে কেন এই প্রোগ্রাম প্রয়োজন? এই তো আমার সর্বশেষ বইয়ের একটা অধ্যায়ে আমি নারীদের নিয়ে লিখেছি।’ 

অর্থাৎ ব্যাপারটা দাঁড়াল এমন, নারীদের স্থান-কাল-পাত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ওই রকম একটা অধ্যায় লেখাই যথেষ্ট। আমার মনে হলো, এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরোতেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন প্রোগ্রামের দরকার। আরও যা দরকার তা হলো ইতিহাসের নারীবাদী পাঠ। 

ইতিহাসের নারীবাদী পাঠ স্বতন্ত্র। কেননা, এ পাঠের কেন্দ্রে সাধারণত অনুচ্চারিত অভিজ্ঞতার কথা থাকে। এই পাঠ পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের গতানুগতিক ধারণা বদলে দেয়। এই পাঠের প্রধান চরিত্র অপেক্ষাকৃত দুর্বল যেমন নারী, যৌন সংখ্যালঘু এবং দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষেরা । নারীবাদী ইতিহাসবিদের কাজ হলো মনোযোগের আড়ালে থাকা বিষয়বস্তুতে আলো ফেলা। একজন বিজ্ঞ নারীবাদীমাত্রই জানেন, মুছে ফেলা বিষয়বস্তুকে যত প্রকাশ্যে আনা যাবে, ইতিহাসের পাঠ ততই ভিন্নতর হবে, এমনকি প্রচলিত ধারণার একেবারে উল্টোও হতে পারে।

নারীবাদী ইতিহাসের শক্তি নিহিত নারীর বিচিত্র অভিজ্ঞতা এবং তার পরিচয়কে তুলে ধরে সমাজকে চ্যালেঞ্জ করায়, যা ইতিহাসের একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক পাঠকে গতি দেয়। উদাহরণ হিসেবে অন্য যুগের এক নারীর কথা বলতে চাই। সময়টা তাজমহল নির্মাণের ৭ দশক আগে ১৫৮৭ সালের দিককার। লাহোরের মোগল কিল্লার হেরেমের আড়ালে ৬৪ বছর বয়সী গুলবদন বেগম তখন নিরন্তর লিখে চলেছেন। সহজভাবে বলতে গেলে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে তাঁকে লিখতে আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

তৃতীয় মোগল বাদশা আকবর নিজের গুরুত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সেই বোধ থেকেই তাঁর সাম্রাজ্যের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখার উদ্যোগ নেন। এ কাজে তিনি বেশ কিছু মানুষের সহযোগিতা প্রার্থনা করেছিলেন। তাঁদের একজন গুলবদন বেগম। তিনি একাধারে একজন নারী, রাজকুমারী ও বাদশাহ আকবরের ফুফু। উজ্জ্বল চোখের গুলবদন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন, ছিলেন দক্ষ লেখক। 

এমন এক সময়ে তিনি গদ্য লিখেছেন, যখন কেবল পদ্যই ছিল নারীর জন্য নির্ধারিত। তাঁর ওপর আকবরের গভীর আস্থা ছিল। সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গুলবদন তাঁর পরিবারের সঙ্গে দশকের পর দশক এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করেছেন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকেছেন। মোগল সাম্রাজ্যের ঘটনাপ্রবাহ ও অর্জন তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। ফলে এ সময়কার ঘটনাপ্রবাহ মনে রাখা ও লিপিবদ্ধ করায় তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।

যে বইটি পরে প্রকাশিত হয়, তা ছিল এককথায় অতুলনীয়। মোগল আমলের এই জেন অস্টিন, প্রথাগত পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত ভাষ্যের বাইরে বেরিয়ে এসে তাঁর নিজের ও আর সব নারীর জীবনালেখ্য লিখে গেছেন। এ বই-ই একমাত্র বই, যেখানে মোগল আমলে নারীদের উচ্ছলতা, সাহসিকতা ও অদ্ভুত সব ঘটনার বিবরণ আছে। আমি ধারণা করি, আকবর এই বর্ণনা পড়ে খুব সন্তুষ্ট হননি। তিনি চেয়েছিলেন মোগল পুরুষদের বীরত্বগাথা লেখা হোক। লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে গুলবদন বেগমের লেখা বইয়ের একমাত্র পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে, যার ৮৩ পৃষ্ঠায় একটি বাক্যের মাঝখানে এসে হঠাৎ শেষ হয়ে গেছে বইটি।

৩০০ বছর পর ১৮৯৯ সালে ৫৭ বছর বয়সী শ্রবণপ্রতিবন্ধী আনেট বেভারিজ হিমশিম খাচ্ছিলেন লন্ডনের ৩৯ মাইল বাইরে বিপুল ধনসম্পত্তি সামলাতে। তবে দিগন্তবিস্তৃত চারণভূমির দিকে নয়, তাঁর মন পড়েছিল গুলবদনের স্মৃতিকথার ইংরেজি অনুবাদে। ১৯০১ সালের জানুয়ারিতে রানি ভিক্টোরিয়া যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন বেভারেজ ফারসি থেকে গুলবদনের স্মৃতিকথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে ইতিহাসচর্চায় বিশেষ অবদান রাখেন।

আপনি হয়তো ভাবছেন, মোগল কোনো নারীর লেখা একমাত্র ইতিহাস গ্রন্থ বা গদ্যগ্রন্থ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছিল। নাহ! আধুনিক যুগের ঐতিহাসিকেরা গুলবদনের চমৎকার এ বইকে একপাশে সরিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরাও বেভারিজের প্রকাশকদের চোখ দিয়েই দেখেছিলেন বইটিকে। বেভারিজের বইটি তাঁর প্রকাশক গ্রহণ করেছিলেন বটে, তবে তাঁর (বেভারিজের) পাঠানো চিঠির জবাবে লিখেছিলেন, ‘ছোট একটুকরা ইতিহাস ...ছোট বৈ আর কিছু নয়।’

আমি গুলবদন বেগম সম্পর্কে ১৯৯৬ সালে প্রথম জানতে পারি বেভারিজের ইংরেজি অনুবাদ থেকে। এক বছর পর আমি অক্সফোর্ডে আমার স্নাতক শুরু করি। আমি দ্রুতই ফারসিতে লেখা গুলবদনের স্মৃতিকথায় বিমোহিত হয়ে পড়ি। ওই সময় গবেষণার জন্য দিনের বড় অংশ আমাকে কাটাতে হতো ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। বইটি ছিল ওখানেই। আমি দেখলাম, রাজকুমারীর লেখা বইটির পাতায় পাতায় মোগল নারীদের হিম্মত আর তাঁদের ঘটানো অবিশ্বাস্য সব ঘটনার বিবরণ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। প্রথা ভাঙা নারী, ক্ষুরধার মেধার খোজা, ক্রস-ড্রেসার (পুরুষের পোশাক পরা নারী বা নারীর পোশাক পরা পুরুষ), কৃতদাস, শিশুদের শৃঙ্খলিত জীবন—সবই আছে ওতে। 

এই স্মৃতিকথাকে ধন্যবাদ। এই স্মৃতিকথাই আমাকে মোগলদের নারীবাদী ইতিহাস নিয়ে লিখতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। আমার লেখায় মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠেছিল নারী আর হেরেমের গড়পড়তা বাসিন্দারা। তাঁদের খুঁটিনাটি কাজ-কারবার, তাঁদের রুচি আর আগ্রহ—এই সবকিছুকে পরে আমি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। আমি যখন বইটি লিখতে শুরু করি, তখন এক পুরুষ সহকর্মী এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কীভাবে এই ইতিহাস লিখবে? কোনো তথ্যসূত্র তো নেই।’

আমি নিশ্চিত। যেকোনো নারীবাদী বিজ্ঞজনকে এই একই বা কাছাকাছি ধরনের প্রশ্ন শুনতে হয়।

আমার সূত্র আসলে তাঁরাই, যাঁদের ঐতিহাসিকেরা দূরে ঠেলে রেখেছিল। এই যেমন রাজকুমারীর স্মৃতিকথা। তাই বলে আমি যে আর সব বইকে নাকচ করে দিয়েছি বা যে গ্রন্থগুলোকে আকর গ্রন্থ বলে ধরা হয়, সেগুলো যে আমি পড়িনি, তা নয়। আমি শুধু এই বইগুলোকে একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেছি। 

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রকৃত সত্য কোনটা? কে ঠিক করেছে কোনটা সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হবে, আর কোনটা বর্জন করতে হবে? কেন সেটা ইতিহাস? তথ্যসূত্র কোন বিবেচনায় ‘আনুষ্ঠানিক’, ‘ধ্রুপদি’ কিংবা ‘দুর্বল’ হয়? পণ্ডিতেরাও ইতিহাস কীভাবে লেখা হচ্ছে, কীভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে, তার দায় এড়াতে পারেন না। আমার প্রথম বইটি প্রশংসিত হলেও তথ্যসূত্র যথেষ্ট না হওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। বইয়ে এই অভিযোগকে আমি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম।

গুলবদনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অভূতপূর্ব এ কাজে একজন নারীর দৃষ্টিতে ঐতিহাসিক নানা ঘটনা, মোগলদের এক স্থান থেকে অন্যত্র স্থানান্তরের তথ্য পেতে পারেন ঐতিহাসিকেরা। বহু বছর ধরে চলা ইতিহাসচর্চায় যুক্ত হতে পারে নতুন কিছু। ১৯০২ সাল থেকেই বেভারিজের করা ইংরেজি অনুবাদটি ছিল, কিন্তু কেউ বইটির দিকে ফিরেও তাকায়নি। 

সিংহভাগ ঐতিহাসিকের মতো, মোগল পণ্ডিতেরাও ভাবতেন, ইতিহাসে পুরুষেরাই থাকবে কেন্দ্রে। ‘বড়’ ‘বড়’ মানুষই কেবল ইতিহাসের ভাষ্য উপস্থাপন করবেন যেমন সম্রাট, আমলা, যোদ্ধা, মুনি-ঋষি ইত্যাদি। কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রাষ্ট্র অনুমোদিত রেকর্ড, পরিসংখ্যান, কর, সেনাবাহিনী, বিজয়ের হিসাবই সব সময় ‘সত্য ও নির্মোহ তথ্য’ বলে গণ্য হয়। ফলাফলও হয় আপনি যেমনটি ভাবছেন, তেমনই। রুক্ষ-সূক্ষ্ম, বিচ্ছিন্ন, নারী চরিত্রবিহীন ইতিহাস। যেসব ঘটনা আন্তরিক, যেখানে নারী আছে, ছোটখাটো মুহূর্তের বিবরণ আছে অথবা যেখানে মানুষের আবেগ-অনুভূতির ছিটেফোঁটা বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, এমন সব কবিতা অথবা রাষ্ট্র অনুমোদিত শিল্পকলা অথবা নারীর কাজকে ইতিহাসের বৈধ সূত্র বলে মানতে রাজি নন অনেকে। অনুভূতি কখনো যুক্তি হতে পারে না, এই হলো তাঁদের কথা।

বহু দশকজুড়ে গুলবদনের এই সমৃদ্ধ স্মৃতিকথা পাদটীকা বা কখনো কখনো রচনায় উল্লেখিত হয়েছে। কথোপকথনের মতো করে লেখা তাঁর এ বইয়ে বহু মানুষের গল্প আছে। ঘটনাক্রম সব সময় সাল-তারিখ অনুসরণ করে লেখা হয়নি। নতুন কোনো ঘটনার কথা লিখতে গিয়ে তিনি অতীতকে টেনে এনেছেন। যুদ্ধে নিহত শিশু, অপূর্ণ আশা, ভালোবাসা বা বিয়ের প্রত্যাশা, যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে নানা ঘটনার বিবরণ লিখেছেন তিনি। বিয়ে, আকাঙ্ক্ষা, সার্বভৌমত্ব শুধু নারীর অভিজ্ঞতা নয়, এ অভিজ্ঞতা অনেকের, সর্বজনীন।

নারীকেন্দ্রিক তথ্যসূত্র নিয়ে পুরুষদের অবিশ্বাসের আরেক দৃষ্টান্ত খুঁজে পাই নূরজাহানের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে। মোগলদের একমাত্র নারী শাসক সম্পর্কে নথিপত্রের কোনো সীমা নেই। আমি যখন তাঁর জীবনী নিয়ে কাজ করছিলাম, একজন পুরুষ সহকর্মী আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কিন্তু নূরজাহান কি শুধুই একটি প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র নন?’ নূর তাঁর সম্পর্কে লেখার জন্য কাউকে কখনো নির্দেশ দেননি, এ তথ্যে তিনি চমকিত হন। নূরজাহান তো নিজেও কোনো স্মৃতিকথা লেখেননি। ওই পণ্ডিত যা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, তা হলো সম্রাজ্ঞীর নির্দেশনা, যেখানে তাঁর সাক্ষর ও ডাকটিকিট আছে। মোগলদের মধ্যে তিনিই একমাত্র নারী, যাঁর নামে মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছিল। 

তিনি অসাধারণ সব বাগান, সরাইখানা, তাঁর মা-বাবার সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ করিয়েছিলেন। এসব নির্মাণ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে পরে তাজমহল নির্মিত হয়েছিল। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী, চতুর্থ মোগল সম্রাট, নূরজাহানের ব্যক্তিগত ও প্রকাশ্য জীবন নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন। সভাসদ ও কূটনীতিকেরা তাঁকে নিয়ে লিখেছেন ঈর্ষাভরে। রাজচিত্রকর এই সম্রাজ্ঞীর যে প্রতিকৃতি এঁকেছেন, তা তাঁর আগের আঁকা সব চিত্রকর্মের চেয়ে ব্যতিক্রমী। এমন এমন জায়গায় নূরজাহান আসীন ছিলেন, যা অপ্রত্যাশিত ছিল। এ তথ্য জানতে আমি কেবল শৌর্য-বীর্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মোগল শাসকদের মতো তাঁকেও একটু খুঁজেছি।

‘কোনো তথ্যসূত্র নেই’, ‘তিনি কি শুধুই প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র ছিলেন না’ বলার মানে তাঁরা প্রচলিত ভাষ্যকে প্রশ্ন করতে চান না। নারীর বক্তব্য, নারীর চিন্তা নিয়ে তাঁদের অবিশ্বাস চরমে। এই যে শুধুমাত্র মোগলদের বেলাতেই ঘটেছে, তা নয়; সারা বিশ্বেই নারী ও যৌন সংখ্যালঘুদের ভাষ্য যথার্থ বলে গণ্য হয় না।

বেভারিজ গুলবদনের আরও একটি অবিকৃত ও সুরক্ষিত পাণ্ডুলিপি খুঁজেছিলেন। তিনি তেমনটি আর খুঁজে পাননি। তার বদলে তিনি তাঁর ভাষায় একটি ত্রুটিপূর্ণ পাণ্ডুলিপি পেয়েছিলেন। যতটুকু জানা যায়, স্মৃতিকথা লেখার আগে গুলবদন একাই কাউকে কিছু না জানিয়ে তীর্থযাত্রায় আরবে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে কাটিয়েছিলেন প্রায় চার বছর। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হেরেমের একদল নারী। বাড়ি ফেরার পথে এডেন বন্দরের কাছে তাঁদের জাহাজ ডুবতে বসেছিল।

আরবে তাঁরা এতই আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন যে তুরস্কের সুলতান তৃতীয় মুরাদ তাঁদের পরে বের করে দেন। মুরাদ মুসলমানদের পবিত্র নিদর্শনগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। গুলবদনের কাজের যে অংশটুকু ইতিহাসে জায়গা পায়নি, অথবা যে কাগজগুলো ছিঁড়ে রাখা হয়েছিল, হয়তো সেগুলো সম্রাটের কর্মচারীরা প্রকাশ হতে দিতে চাননি। 

শত বছরের বই ও উপাখ্যান অমূল্য। এর প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে সে সময়ের মানুষের যাপিত জীবনের সৌন্দর্য, তাদের আনন্দ-বেদনা-আকাঙ্ক্ষা
আমরা অনুধাবন করি। এই দুর্লভ সম্পদ হাতে এলে আমরা অন্য কোনো এক সময়ে চলে যাই। ইতিহাসের নানা উপকরণ, কোনো ঘটনার সূত্রপাত, তাকে ঘিরে অনিশ্চয়তা কিংবা নতুন কোনো আবিষ্কার প্রত্যক্ষ করি। নারীবাদী ইতিহাসের পাঠ এগোয় ধীরে এবং প্রায়ই এই ইতিহাসের ভাষ্যকার হন নারীরাই। বেভারিজ শুধু গুলবদন বেগমের স্মৃতিকথা অনুবাদ করবেন বলেই ফারসি শিখেছিলেন। আমি বছরের পর বছর নথিপত্র সংগ্রহ করেছি মোগল নারীদের সাহস আর কল্পনায় ভরপুর অ্যাডভেঞ্চারের সুলুকসন্ধানে।

রুবি লাল ভারতের পুরস্কারপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক ও এমোরি ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অধ্যাপক। ইতিহাসবিস্মৃত নারীদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ভ্যাগাবন্ড প্রিন্সেস: দ্য গ্রেট অ্যাডভেঞ্চার্স অব গুলবদন। প্রতিবেদনটি টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত, ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ।


● প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম।