অভিজিৎ হত্যা মামলার রায়

ছয় বছর পর বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক অভিজিৎ হত্যা মামলার রায় হলো। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ রায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলা থেকে বের হতেই টিএসসির মোড়ে ওত পেতে থাকা জঙ্গিরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে। অভিজিতের সঙ্গে থাকা তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বাধা দিতে গেলে তারা তাঁকেও কুপিয়ে গুরুতর আহত করে।

মঙ্গলবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ আদালতের বিচারক মো. মজিবুর রহমান সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তা জিয়াউল হকসহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। অপর চার আসামি হলেন আকরাম হোসেন, আবু সিদ্দিক সোহেল, মোজাম্মেল হোসেন ও আরাফাত রহমান। শফিউর রহমান ফারাবী নামের এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। তাঁরা সবাই জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন পলাতক। তাঁরা জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলায়ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।

আশির দশকে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) মাধ্যমে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। এরপর জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) দৃশ্যপটে আসে। আরও পরে সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় আনসার আল ইসলাম। এ সংগঠনের সদস্যরা মুক্তমত ও ভিন্ন চিন্তার বহু মানুষকে হত্যা করে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত যথার্থই বলেছেন, মতপ্রকাশে সাহস দিতেই এ রায়। কেননা এ হত্যার উদ্দেশ্য হলো জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বন্ধ এবং নিরুৎসাহিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ লেখালেখি ও মতপ্রকাশ করতে না পারে। বিলম্বে হলেও আলোচিত দীপন ও অভিজিৎ হত্যা মামলার রায় হওয়ায় ন্যায়বিচারের পথ মুক্ত হলো। তবে উচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তির পরই বলা যাবে অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছেন।

উদ্বেগের বিষয় হলো, এ দুই হত্যাসহ আরও অনেক হত্যার মূল পরিকল্পক জিয়াউল হক এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিজিতের স্ত্রী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী রাফিদা আহমেদ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘ছয় বছর অনিশ্চয়তা আর দীর্ঘসূত্রতার পর আজ আমরা একটি রায় পেলাম। অল্প কিছু চুনোপুঁটির বিচার করে জঙ্গিবাদের উত্থান ও শিকড় উপেক্ষা করা ন্যায়বিচার হতে পারে না।’

রাষ্ট্রের উচিত পলাতক দুই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে খুঁজে বের করে আদালতের রায় কার্যকর করা। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বলেছে, জিয়াউল হক দেশেই আছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে আটক করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে হবে। আর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করে তাঁকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।

মাননীয় আদালত মতপ্রকাশে সাহস দিতেই এ রায় বলে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গিরা ভিন্নমত সহ্য করে না, এ কথা সবার জানা। সরকারের দাবি, জঙ্গিবাদকে তারা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু স্বাধীন মতপ্রকাশ করার জন্য যে মুক্ত পরিবেশ থাকা দরকার, বাংলাদেশে তা অনেকটাই অনুপস্থিত। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে এমন বার্তা দেওয়া হয়, যা মুক্তমতকে নিরুৎসাহিত করে। এ অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন। জঙ্গিদের তৎপরতা ও হামলাকে নিছক আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে দেখলে চলবে না। যে অপরাজনীতি ও চিন্তা মানুষ হত্যায় প্ররোচিত করে, সে বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। সমাজে ভিন্নমত ও মুক্তচিন্তা চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে জঙ্গিবাদী ধ্যানধারণার বিস্তার ঠেকানো সম্ভব হবে।