আবার সড়কে প্রাণহানি

ঢাকা মহানগরে চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতা চলে, তা আমরা প্রতিদিন দেখছি। এই প্রতিযোগিতার পরিণতি কতটা প্রাণঘাতী ও মর্মান্তিক হতে পারে, তা-ও আমাদের দেখতে হচ্ছে। প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দুটি বাসের চাপায় তরুণের হাত বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং পরিণামে মৃত্যুর আগে ও পরে অনেক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সর্বশেষ গত রোববার ঢাকার কুর্মিটোলা উড়ালসেতুর ঢালে একই রকমের দুর্ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে দুই শিক্ষার্থী কিশোর-কিশোরীর মর্মান্তিক মৃত্যু হলো, আহত হলো আরও নয়জন।

শহীদ রমিজউদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের কিছু শিক্ষার্থী কলেজ ছুটির পর রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল বাসে ওঠার অপেক্ষায়। সেখানে আরও কিছু অপেক্ষমাণ মানুষ ছিল। যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দুটি বাসের একটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের চাপা দেয়। ফলে ঘটনাস্থলেই মারা যায় দুই ছাত্রছাত্রী। এ ধরনের প্রতিযোগিতার এটাই সাধারণ পরিণতি। এটাকে ঠিক দুর্ঘটনা বলা যায় না। কারণ, এ রকম ঘটা অনিবার্য ছিল না। যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতায় পরস্পরকে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করলে এই প্রাণহানি ঘটত না।

সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক, কিন্তু এ ধরনের অপমৃত্যু মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন। ১৬ ও ১৭ বছরের যে দুই শিক্ষার্থী সবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ছিল, সামনে ছিল তাদের পুরো জীবনটাই; তারা কলেজে পড়াশোনা করছিল, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছিল। মা-বাবারও অনেক স্বপ্ন ছিল তাদের নিয়ে। একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম নিজেও একজন বাসচালক। তিনি দূরপাল্লার বাস চালিয়ে দুই মেয়ে ও এক ছেলের পড়াশোনার খরচ জুগিয়ে আসছেন।

ঢাকা মহানগরীর ভেতরের রাস্তাঘাটে অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে চালকদের মধ্যে যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতার কারণে। এই প্রতিযোগিতা একটি সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে, যেন এর কোনো প্রতিকার নেই। এই মহানগরীতে চলাচলকারী প্রতিটি বাস-মিনিবাসের গায়ে অজস্র আঁচড় ও ঘর্ষণের দাগ সে সাক্ষ্যই দেয়। যানবাহন চলাচলে ন্যূনতম শৃঙ্খলা থাকলে কোনো সভ্য দেশের রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনের চেহারা এ রকম হতে পারে না। বাসগুলোর মধ্যে যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতা চলে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের সামনেই। তাঁরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে এসব চলতে পারত না।

জাহাঙ্গীর আলম তাঁর ৩০ বছরের বাস চালানোর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু সত্য কথা বলেছেন, যা গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, এখন রাজনৈতিক বা অন্য প্রভাব খাটিয়ে ঢাকায় একটার পর একটা বাস কোম্পানি তৈরি হচ্ছে। বাসমালিকেরা আত্মীয়-পরিজন যাঁকে পাচ্ছেন, তাঁকেই স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে দিচ্ছেন। এসব চালকের বেশির ভাগই নেশাগ্রস্ত। কেউ কেউ গাড়ি চলন্ত অবস্থায়ও গাঁজা খান।

এসব কথা শুধু ঢাকার নয়, সারা দেশের বাস ও ট্রাকের চালকদের একটা
বড় অংশের ক্ষেত্রে সত্য। এর সঙ্গে আছে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক, যাঁদের কোনো প্রশিক্ষণ নেই, যাঁরা সহকারী থেকে চালক হয়েছেন। এই চালকদের যান চালানো বন্ধ করা খুব প্রয়োজন। কারণ, অধিকাংশ দুর্ঘটনা
ঘটে তাঁদের কারণেই। ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান
চালানো প্রয়োজন।

ঢাকার ভেতরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও অঙ্গহানির ঘটনাগুলো সার্বিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে, নইলে এসব দুর্ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতায় বেপরোয়া বাস চালানো চিরতরে বন্ধ করার জন্য অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। নির্ধারিত স্থান ছাড়া বাস থামতে পারবে না, এটা নিশ্চিত করা দরকার। সেই সঙ্গে রাস্তা পারাপারে জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস ও ফ্লাইওভারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।