ইউপি নির্বাচন

সম্পাদকীয়

ছয় ধাপে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) নির্বাচন হওয়ার কথা, যার পাঁচটি ধাপে ৩ হাজার ৭৫৫টি ইউপির মধ্যে ৩৪৮টিতে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০৭ জন। এ ধারা বজায় থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো সব ইউপি চেয়ারম্যানই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হয়ে যাবেন; দেশবাসীকে আর নির্বাচনী খাতে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় বহন করতে হবে না। আদর্শ নির্বাচনই বটে!

আগে মানুষ নির্বাচনকে নিত উৎসব হিসেবে, প্রার্থীরা উৎসবমুখর পরিবেশে নিজেদের বক্তব্য ভোটারদের সামনে তুলে ধরতেন। ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতেন। এখন ভোটের কথা শুনলেই জনমনে আতঙ্ক দেখা দেয়, নির্বাচনের আগেই অস্ত্রের মহড়ার পাশাপাশি জিবকে শাণিত করার কৌশল নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের রাশভারী নেতা, প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ইউপি নির্বাচন বর্জন করায় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকধারী ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে।

উৎকণ্ঠার বিষয় হলো প্রতীকধারীরা কোনোভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জিবের ধার পরীক্ষা করছেন; কখনো কখনো তা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। পাবনার বেড়া পৌরসভা নির্বাচনে ছেলেকে বিজয়ী করতে পাবনা-১ আসনের সাংসদ শামসুল হক প্রতিপক্ষের লোকজনকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘কোনো দয়ামায়া না করে পিষে মেরে ফেলা হোক।’ সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সাংসদ হাসিনা দৌলা নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বিদ্রোহী প্রার্থীদের হাত-পা ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাংনী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল খালেক ইউপি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে একবারের জায়গায় প্রয়োজন হলে তিনবার ব্যালটে সিল মারার নির্দেশ দিয়েছেন। রাজশাহী জেলার বাগমারার গোবিন্দপাড়া ইউনিয়নের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট না দিলে হিন্দুধর্মের লোকজনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার ঘোষণা দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। লক্ষ্মীপুরের এক আওয়ামী লীগ নেতা নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিলে ‘ধরে এনে ক্রসফায়ার’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এ ছাড়া নৌকায় ভোট না দিলে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই বলেও সমন জারি করেছেন সেখানকার আরেক আওয়ামী লীগ নেতা।

ইউপি-পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যে একে অপরকে গালাগাল করছেন, হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, এখানে তার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো মাত্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী এ রকম অজস্র ‘অমিয় বাণী’ শুনেছেন। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের অভিযোগ, বিএনপি আন্দোলন ও নির্বাচন বানচালের নামে দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, কিন্তু ইউপি নির্বাচন ঘিরে বিএনপির কোনো তৎপরতাই নেই। তারা বর্জনের ঘোষণা দিয়েই চুপচাপ আছে। তাহলে ইউপি নির্বাচন ঘিরে যে এ অস্ত্রের মহড়া ও অশালীন বাক্যমালা বর্ষিত হচ্ছে, তার দায় ক্ষমতাসীনদেরই নিতে হবে। মানুষের ভোটাধিকার অনেক আগেই নির্বাসিত। এখন শালীনতা, সৌজন্যবোধও রাজনীতির মাঠ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের নামে একে অপরকে দেখে নেওয়া ও দেখিয়ে দেওয়ার এ মহড়া বন্ধ হোক। নির্বাচন কমিশনের চৈতন্যোদয় ঘটুক।