উন্নয়নে ভারসাম্য থাকা জরুরি

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে যে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, তা খালি চোখেই দেখা যায়। এ জন্য গবেষণা বা পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না। ১৯৭৪ সালে যেখানে জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ শহরাঞ্চলে বসবাস করত, সেখানে বর্তমান বাস করছে ৪০ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ তা দাঁড়াবে ৬০ শতাংশে।

এটি একদিকে আশার কথা, অন্যদিকে শঙ্কারও। টেকসই উন্নয়নের জন্য ভারসাম্যমূলক নগরায়ণ দরকার। আমরা যদি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ নগরায়ণ করতে না পারি, তাহলে পরিবেশগত বিপর্যয় তৈরি হতে পারে। এসব কথা উঠে এসেছে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত সেমিনারে বিশেষজ্ঞদের কথায়। বাংলাদেশের নগরায়ণ মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, রাজধানী ঢাকাই আমাদের উন্নয়ন ও নগরায়ণের কেন্দ্রবিন্দু। ফলে সামগ্রিক উন্নয়ন ও নগরায়ণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

গ্রাম প্রকৃতিনির্ভর হলেও শহর পুরোপুরি পরিকল্পিত। যদিও বাংলাদেশের শহরগুলো গড়ে উঠেছে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে। বিশেষ করে স্বাধীনতার পর ঢাকা ও চট্টগ্রামে যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে, শিল্পকারখানা ও স্থাপনা হয়েছে, সেই হারে অবকাঠামো, তথা নাগরিক সুবিধা বাড়েনি। টেকসই হয়নি যোগাযোগব্যবস্থাও। ঢাকা শহরে সড়কের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে। উদ্বেগের বিষয় হলো সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় রাজধানী যত বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, ঢাকার বাইরের শহরগুলো ততই অবহেলার শিকার হচ্ছে।

ঢাকা দেশের রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। তাই বলে শিল্পকারখানা, সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর ঢাকায় হতে হবে কেন? পৃথিবীর অনেক দেশে প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক রাজধানী ভিন্ন ভিন্ন শহরে থাকে। একসময় যোগাযোগব্যবস্থার দুর্বলতার দোহাই দেওয়া হতো। এখন যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেছে, তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারিত হয়েছে, তারপরও সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক করার কোনো যুক্তি নেই।

সরকার মুখে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলে কিন্তু তাদের কাজকর্মে এককেন্দ্রিকতাই অগ্রাধিকার পায়। প্রশাসনের কাজকর্মে গতি আনতেই বিভাগীয় ও জেলা শহরের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল। বাস্তবে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নীতিনির্ধারণী কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ফলে যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য তাদের ঢাকায় আসতে হয়। এটি আর্থিকভাবে যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সময়সাপেক্ষও।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকায় প্রতিবছর ছয় লাখ নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এই ধারা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের আগেই ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হবে। ঢাকা শহর কোনোভাবেই বর্ধিত জনসংখ্যার ভার বহন করতে পারছে না। ঢাকার অদূরবর্তী নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরও জনসংখ্যার ভারে প্রায় ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে।

সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থেই সরকারকে অন্যান্য শহরের উন্নয়নে টেকসই পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলে নগরায়ণ সম্প্রসারিত হবে বলে অনেকে আশা করেন। কিন্তু যমুনা সেতু হওয়ার পরও উত্তরাঞ্চলে নগরায়ণ হলো না কেন? চট্টগ্রাম শহরকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যখন চট্টগ্রামের কিংবা বগুড়ার কোনো শিল্পোদ্যোক্তা মনে করবেন তাঁর ব্যবসাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তাঁকে ঢাকায় যেতে হবে না, তখনই আর তিনি সেখানে থাকতে আগ্রহী হবেন না। অন্যথায় ঢাকামুখী হবেন।

অতএব ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন ও নগরায়ণের চিন্তা বাদ দিয়ে সমন্বিত ও সামগ্রিক নগরায়ণের প্রতিই মনোযোগ দিতে হবে।