এক বছরে ৫০ দুর্ঘটনা

নৌপথ নিরাপদ রাখার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, কর্তৃপক্ষ সেগুলোর কোনোটি নিচ্ছে না। ফলে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনা যদি নৌযান কিংবা নির্মীয়মাণ সেতুর ক্ষয়ক্ষতির ওপর দিয়ে যায়, তাহলে এ নিয়ে উচ্চবাচ্য হয় না। দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেলে কিছুটা হইচই হয়।

৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় শীতলক্ষ্যার নির্মাণাধীন তৃতীয় সেতু এলাকায় এক সাংসদের মালিকানাধীন কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ‘সাবিত আল হাসান’ নামের একটি লঞ্চ ডুবে ৭ শিশুসহ ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এর আগেও সেখানে দুর্ঘটনায় মানুষ মারা গেছে।

৪ এপ্রিলের দুর্ঘটনার পর প্রথম আলো অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু এলাকায় গত এক বছরে ৫০টি নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে নির্মীয়মাণ পিলারের সঙ্গে নৌযানের ধাক্কা লেগে। সেতুর পিলার বাঁকা হয়ে যাওয়ায় নৌযানের মালিককে জরিমানা দিতে হলেও সেতুর ঠিকাদার কোনো জরিমানা দিয়েছেন বলে জানা নেই।

দুর্ঘটনার মূল কারণ নদীর প্রশস্ততা মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া। এ ছাড়া নৌযানগুলোর বেপরোয়া গতি ও নির্মীয়মাণ সেতুর পিলার ও অন্যান্য সরঞ্জাম রাখার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

বাংলাদেশ নদী কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, কেবল শীতলক্ষ্যা নদীতেই দুই হাজার দখলদার আছে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় শীতলক্ষ্যায় নৌযান চলাচল বেড়েছে। বিশেষ করে মুন্সিগঞ্জসহ বিভিন্ন বালুমহাল থেকে বালুবাহী বাল্কহেডগুলো শীতলক্ষ্যা দিয়েই পূর্বাচল ও সংলগ্ন এলাকার নির্মাণকাজের রসদ জুগিয়ে থাকে। বিআইডব্লিউটিএর তথ্যমতে, ১৯৬০ সালে শীতলক্ষ্যার মোহনায় নদীর প্রশস্ততা ছিল ৭৮০ মিটার, ২০২০ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩৬৫ মিটারে। গত ৬০ বছরে শীতলক্ষ্যার ডেমরা অংশে ১০৬ মিটার, নবীগঞ্জ ফেরিঘাট অংশে ১৫৩ মিটার, বন্দর ফেরিঘাট অংশে ১৩৭ মিটার এবং শীতলক্ষ্যার মোহনায় শাহ সিমেন্ট পয়েন্টে ৪১৫ মিটার প্রশস্ততা কমেছে। এর অর্থ নদীর বেশির ভাগই দখলদারেরা গিলে ফেলেছেন।

বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ ঢাকার চারপাশের নদী দখল নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, অনেক সিদ্ধান্ত ও অভিযান চলেছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও নদী রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতি ঠেকানো যায়নি। ভবিষ্যতে যাবে, তারও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দূষণ ও দখলে নদী মরে যাচ্ছে।

নদীই যদি না থাকবে, নৌযান চলাচল করবে কীভাবে? তাই প্রথমে নদীগুলোকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। প্রশস্ততা
বাড়াতে হবে।

দ্বিতীয়ত, শীতলক্ষ্যা তৃতীয় সেতু নির্মাণ নিয়ে যে সমস্যাটি দেখা দিয়েছে, এটি সমাধান করা কঠিন ছিল না, যদি সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হতেন। সেতু নির্মাণ করে সেতু বিভাগ। নৌপথ তদারক করে বিআইডব্লিউটিএ। এই দুই সংস্থার মধ্যে ন্যূনতম সমন্বয় নেই। নির্মীয়মাণ সেতুর ঠিকাদারের একজন প্রহরী দিয়ে নৌযান নিয়ন্ত্রণের কাজ চলতে পারে না। এ জন্য সেখানে বিআইডব্লিউটিএর সার্বক্ষণিক পাহারা বাড়াতে হবে। আর সেতু বিভাগও বিষয়টি কেবল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর ছেড়ে দিয়ে দায় এড়াতে পারে না। সড়ক হোক কিংবা নৌপথ হোক, যান চলাচল তদারক করতে হবে। এভাবে একের পর এক নৌদুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পদ হানি মেনে নেওয়া যায় না। বিলম্বে হলেও সংশ্লিষ্টদের চৈতন্যোদয় হোক।