এ কেমন মানবাধিকার কমিশন

সম্পাদকীয়

দুই বছরের কার্যক্রম তুলে ধরতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আহূত সংবাদ সম্মেলনে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি সংস্থাটির চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম ও তাঁর সহকর্মীরা। তাঁদের উত্তরের ধরন দেখে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে তাঁরা আর পাঁচটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো হুকুম তামিল করছেন মাত্র। নিজেদের কোনো স্বাতন্ত্র্য অবস্থান নেই। রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যখন দেশের সীমা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক পরিসরেও আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে, তখন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। রাষ্ট্র দ্বারা নাগরিকের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, তার প্রতিকার করা মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা কমিশনের কাছে প্রতিকার চাইলে তাদের কাজ হবে সেটি আমলে নিয়ে তদন্ত করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রতিকার করতে বলা। এ ব্যাপারে ব্যত্যয় ঘটলে মানবাধিকার কমিশন উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে। যদিও এ রকম কোনো নজির জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এ ছাড়া স্বতঃপ্রণোদিতভাবেও তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করতে পারে।

বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের যাত্রা শুরু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে অধ্যাদেশের মাধ্যমে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে নতুন আইন করে এবং কমিশন পুনর্গঠন করা হয়। এরপর এক যুগ পার হলেও সংস্থাটি মানবাধিকার রক্ষা বা মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে দৃশ্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ভূতপূর্ব চেয়ারম্যানের আমলে বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন কিছুটা আওয়াজ তুলেছিল; এখন আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, তাঁরা কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী। কিন্তু সেই কাজ দেশবাসী দেখতে পাচ্ছে কি?

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব ও এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সাংবাদিকেরা কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু চেয়ারম্যান বা তাঁর সহকর্মীদের কেউ সদুত্তর দিতে পারেননি। চেয়ারম্যান বলেছেন, ২০১৮ সালের মে মাসে কক্সবাজারের টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় মামলা হওয়ায় তাঁরা সরে এসেছেন। প্রকৃত ঘটনা হলো একরামুলের ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। এ রকম শত শত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ মানবাধিকার রক্ষকদের দৃষ্টির বাইরে থেকে গেছে।

কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের সুপারিশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর কর্ণপাত করে না। কিন্তু কমিশন আইনের ১৪-এর ৬ ধারায় বলা আছে, এভাবে যদি কোনো কর্তৃপক্ষ কমিশনকে অগ্রাহ্য করে, তারা বিষয়টি রাষ্ট্রপতিকে জানাতে পারবে প্রতিবেদনের মাধ্যমে। আর রাষ্ট্রপতি সেই প্রতিবেদনের কপি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু গত ১২ বছরে কোনো ঘটনা তারা রাষ্ট্রপতিকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। এ কারণে একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে হাইকোর্টের রায়ে মন্তব্য করা হয়েছিল, মানবাধিকার আইনে অর্পিত দায়িত্ব পালনে মারাত্মক গাফিলতির পরিচয় দিচ্ছে; মানবাধিকার কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় ‘জেগে জেগে ঘুমাচ্ছে’।

দেশবাসী ঘুমন্ত নয়, জাগ্রত মানবাধিকার কমিশনই দেখতে চায়, যারা সরকারের অনুগত সংস্থা হিসেবে কাজ করবে না; নিজের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখবেন। নিছক নিয়ম রক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমন মানবাধিকার কমিশন রাখার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।