কৃষকদের স্বার্থ দেখার কেউ কি নেই

সম্পাদকীয়

কৃষি খাতে সার, বীজ ও জ্বালানিতে ভর্তুকির ফলে উৎপাদনে খরচ কম হওয়া ও পণ্য বিক্রিতে কৃষকদের লাভবান হওয়ারই কথা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে উৎপাদনের খরচ তুলতেই হিমশিম খেতে হয় কৃষকদের। কারণ, কৃষি খাতে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, সেসবের সুফলভোগী কৃষকেরা হন না। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে সেই ভর্তুকির লাভের গুড় চলে যায় বিশাল একটা সিন্ডিকেটের পকেটে। সেখানে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা, আমদানিকারক, ডিলার—সবাই জড়িয়ে গেছেন। তাঁদের মাঝখানে ঢুকে পড়েছে অননুমোদিত ব্যবসায়ী, মানে ফড়িয়াবাজ। কিন্তু গোটা বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা জানলেও, দিনের পর দিন এভাবেই চলছে।

বেসরকারিভাবে আমদানি করা, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃক আমদানি করা ও বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন (বিসিআইসি) কর্তৃক উৎপাদিত নন-ইউরিয়া সারে ভর্তুকি দেওয়া, সেই সার একেবারে মাঠপর্যায়ের বিক্রেতা পর্যন্ত কীভাবে পৌঁছাবে, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালা ভঙ্গ করলে নানা শাস্তি ও কঠোর ব্যবস্থার কথাও উল্লেখ আছে। নীতিমালার বাইরে গিয়ে সরকার নির্ধারিত ডিলার ও বিক্রেতা ছাড়া এ সার উত্তোলনের ও বিক্রির সুযোগ নেই কারও। এর অন্যথা হলেই প্রতারিত হতে হবে কৃষককে। এর মানে সরকারের ভর্তুকি দেওয়াটাই বিফলে গেল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সার উত্তোলন নিয়ে অনিয়মের ফলে সেটিই ঘটছে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে।

এসব অঞ্চলের জন্য বিপণনকেন্দ্র হচ্ছে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায়। নীতিমালা অনুযায়ী, ডিলাররা বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি সেখান থেকে সার উত্তোলন করে নিজ নিজ উপজেলায় বিক্রি করবেন। বিক্রয় প্রতিনিধির মাধ্যমে সেটি চলে যাবে কৃষকদের কাছে। কিন্তু ডিলাররা সেটি না করে নওয়াপাড়ার স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সেই সার তুলে নিচ্ছেন। সেই সারের অল্পই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে। উত্তোলিত সার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আবার আমদানিকারকদের বা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এদিকে ডিলার বা বিক্রয় প্রতিনিধির কাছে সার না পেয়ে কৃষককে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত টাকায় সেই সার কিনতে হচ্ছে বাজার থেকে। ইউনিয়ন পর্যায়ে না যাওয়ায় সেই সার পরিবহনেও বাড়তি খরচ হচ্ছে কৃষকদের। ফলে স্থানীয় ব্যবসায়ী হিসেবে সরকার অননুমোদিত কিছু ফড়িয়া সারের বণ্টনপ্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়েছেন। অথচ উত্তোলিত সার উপজেলা পর্যন্ত পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা কৃষি অফিসারের কাছে তাঁরা সারের আগমনী বার্তা দাখিল করবেন এবং উপজেলা কৃষি অফিসার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অন্য কোনো কৃষি কর্মকর্তা সেই সার সরেজমিন পরিদর্শন করে বিক্রির অনুমতি দেবেন। এখন ডিলাররা যে সার নিজ উপজেলায় আনছেন না, নোয়াপাড়াতেই ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন, তা কৃষি কর্মকর্তাদেরই সবার আগে বুঝতে পারার কথা।

ভর্তুকির সুবিধা যাতে কৃষক পেতে পারেন, সে জন্য আমদানি করা সার ডিলারদের মাধ্যমে বিতরণ, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি তদারকির কথা স্বয়ং কৃষি মন্ত্রণালয়ের। জেলা ও উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটি এ তদারকির সঙ্গে যুক্ত। ফলে বোঝাই যাচ্ছে এ তদারকি ঠিকঠাক হচ্ছে না, সরেজমিন যাচাই-বাছাইও করা হচ্ছে না। ফলে এমন অনিয়মের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, এটিসহ ভর্তুকির সার নিয়ে আরও যা অনিয়ম আছে, সব কটিই মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে একেবারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কারও অজানা নয়; বরং তাঁরা নিজেরাই সেই অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। বলতেই হচ্ছে, জনগণের টাকায় কৃষকদের এ ভর্তুকির সুবিধা পুরোটা চলে যাচ্ছে অসাধু কর্মকর্তা, আমদানিকারক, ডিলার ও ফড়িয়াদের পকেটে। এখন মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিভাগের ভেতরে, মানে শর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকে পড়েছে, সেই ভূত তাড়াবে কে? কৃষকেরা এভাবে আর কত ভুক্তভোগী হতে থাকবেন?