শ্রমজীবী মানুষ যখন বিপদাপন্ন, তখন সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো অবশ্যই দরকার। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মানুষ যখন ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়, তখন তার ধর্মের ভাই অন্য মানুষকে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির জন্য পাশে দাঁড়াতে হয়। অসহায় মানুষের দুর্দিনে তাদের সর্বপ্রকার আর্থিক সহায়তা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, চিকিৎসাসেবা ও শুশ্রূষায় এগিয়ে আসা ইমানের দাবি। ইসলামে পারস্পরিক উপকারের চেষ্টা এবং যার যা কিছু সামর্থ্য আছে তদনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে, যাতে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘একটি খেজুরের অর্ধাংশ দিয়ে হলেও দোজখ থেকে বাঁচবে। আর তা যদি না থাকে, তাহলে অসহায়, অভাবী ও হতদরিদ্রদের সঙ্গে মিষ্টি কথা বলবে, ভালো ব্যবহার করবে, যাতে পরকালে তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।’ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যার্থে মোটা অঙ্কের অর্থ দান করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সাহায্য করতে শুধু টাকা-পয়সা দিয়েই নয়, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা করেও মানুষকে সহযোগিতা করা যায়। ইসলাম মানবিক কারণে সামান্য পরিমাণ সহায়তাকেও খাটো করে দেখে না। সে জন্য অতিশয় নগণ্য পরিমাণ দানকেও উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দান-সাদকা দেয়, তা একটি খেজুর পরিমাণও হোক না কেন, আল্লাহ তা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। তবে শর্ত এই যে, তা বৈধ পথে উপার্জিত হতে হবে। কেননা, আল্লাহ এই বস্তুকেই পছন্দ করেন এবং তা বৃদ্ধি করে নেন আর তা এতটাই যে, এই খেজুর এক পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম) মানুষ বিপদে-আপদে একে অন্যের দ্বারস্থ হয়ে থাকে। এ জন্যই যার ধনসম্পদের আধিক্য রয়েছে, তাকে হতদরিদ্র ও সহায়-সম্পদহীনকে সাহায্য করতে পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ‘হে মুমিনগণ! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সেদিন আসার পূর্বেই যেদিন কোনো বেচাকেনা, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৪) ইসলামে দানশীলতা ও বদান্যতার ফলে সমাজে অর্থসম্পদ গুটিকতক ধনী লোকের হাতে পুঞ্জীভূত হওয়ার কুফল থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সাহায্যকারীর দান কখনো বৃথা যায় না, যদি-না তা লোক দেখানো হয়ে থাকে। নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘একটি রুটি দানের কারণে তিন ব্যক্তিকে জান্নাতে পাঠানো হবে। ১. আদেশদাতা, ২. রন্ধনকর্তা, ৩. সেই পরিবেশনকর্তা—যে রুটি নিয়ে গরিবকে দিয়ে পরিবেশন করেছে।’ (হাকিম, তাবারানী)অল্প পরিমাণ আর্থিক সাহায্যেও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কিছু না কিছু উপকার হয়। সবার অল্প সাহায্যের সম্মিলিত রূপও একসময় বিশাল অনুদানের ত্রাণভান্ডারে পরিণত হয়। সমষ্টিগত প্রচেষ্টায় দেশ, জাতি ও সমাজের আপামর জনসাধারণের প্রভূত উপকার, জনকল্যাণ ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধিত হয় এবং মানবজাতি ইহকাল ও পরকালে বিশেষভাবে লাভবান হয়ে থাকে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রোজ কিয়ামতের দিন মানুষ বর্ণনাতীত ক্ষুধা-পিপাসা নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’ অন্য হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘হাশরের ময়দানে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দানশীল লোকেরা তাদের দানের ছায়ার নিচে অবস্থান করবে।’কেউ অসুস্থ হলে তাদের সেবা ও সহযোগিতা করা মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। মানুষের সেবা করাও একটি ধর্মীয় কাজ বা ইবাদত। মানুষ বিপদে পড়লে একে অন্যের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন। তাই জাতীয় দুর্যোগের সময় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সেবায় এগিয়ে এসে তাদের পাশে দাঁড়ানো প্রত্যেকের অবশ্যকর্তব্য। বিপদগ্রস্ত লোকেরা সাহায্যের অর্থ, ত্রাণসামগ্রী, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ বা অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে খুবই উপকৃত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সব সময় অন্যের বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্ট মাথায় রেখে উম্মতদের জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি নিজেও বিপদে-আপদে রুগ্ণ মানুষের সেবা করেছেন, অন্যদের দান-সাদকা ও বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘তোমরা দান-সাদকা করো। এতে আল্লাহ খুব খুশি হন ও দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দেন।’ যে ব্যক্তি শুধু প্রথাগত ইবাদত করে কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় বিপদগ্রস্ত ও আর্তমানবতার কল্যাণের জন্য দান-খয়রাত, জাকাত-সাদকা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে না, সমাজের অসহায়, দুর্গত, ক্ষতিগ্রস্ত গরিব-দুঃখী মানুষের অভাব দূরীকরণ, চরম ক্ষুধা নিবারণ ও দারিদ্র্র্য বিমোচনে দানের হাত সম্প্রসারণ করে তাদের পাশে দাঁড়ায় না, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে অংশগ্রহণ করে না, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর কাছে কখনোই প্রিয়ভাজন হতে পারবে না। মানবিক বিপর্যয় ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আর্তের সেবায় প্রত্যাশিত ভূমিকা রেখে অসহায় মানুষকে বাঁচানোর এখনই সময়। মানুষ দাঁড়াবে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে—এটাই ইসলামের বিধান। ভবনধসের মতো ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় পঙ্গু মানুষের পাশে গিয়ে দান-সাদকা, ত্রাণসাহায্য ও চিকিৎসাসেবা অনেক কাজে আসে। জাতির সংকটকালে মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তাই ধনবানদের উচিত বিলাসী জীবনযাপন পরিত্যাগ করে তাদের বিপুল আয়ের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের দান করা। বিপদাপন্ন মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে যদি নিজেদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় সামান্য ব্যয় সংকোচনের প্রয়োজন হয়, এতে তাদের কুণ্ঠিত হওয়া উচিত নয়। সামর্থ্যবান ও বিত্তশালী সবাই বিপদগ্রস্তদের পাশে এগিয়ে এলে যেকোনো দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা মোটেও কঠিন হবে না। সবাই উদারভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান ও পুনর্বাসনের কাজ সহজেই হয়ে যেতে পারে। জাতীয় দুর্যোগের সময় আর্তমানবতার পাশে দাঁড়িয়ে শ্রেণী-পেশা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দলমতনির্বিশেষে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ-এ চিরসুন্দর সত্যটি ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে জাগ্রত ও উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক! মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক। [email protected]