গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা যাবে না

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে যখন নাগরিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকা না থাকা নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতারা একে অপরকে ঘায়েল করতে জিবের অবাধ স্বাধীনতা ব্যবহার করে আসছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যগুলো আমাদের মোটেই স্বস্তি দেয় না। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার চর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ২০১৯ ও ২০২০ সালের মতো ২০২১ সালেও বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৩৯।

২১০টি দেশ ও অঞ্চলের অবস্থান ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর মধ্যে ৮৪টি দেশ ও অঞ্চলে রাজনৈতিক অধিকার চর্চা ও নাগরিক স্বাধীনতা রয়েছে। ৬০টি দেশ ও অঞ্চলে এ স্বাধীনতার অবস্থা ‘আংশিক স্বাধীন’ এবং ৬৬টি দেশ ও অঞ্চল ‘মোটেও স্বাধীন নয়’ বলা হয়েছে। বাংলাদেশ রাজনৈতিক অধিকারের ৪০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ১৫ এবং নাগরিক স্বাধীনতায় ৬০-এর মধ্যে ২৪ পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪১। অর্থাৎ তিন বছর আগের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান আরও দুর্বল হয়েছে।

ফ্রিডম হাউস বৈশ্বিক স্বাধীনতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতাকে বিবেচনায় নিয়ে থাকে। রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী ব্যবস্থা ও স্বচ্ছতা, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ, সরকারের কার্যকারিতা, নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা, ক্ষমতার ব্যবহার ও স্বচ্ছতা-সম্পর্কিত বিষয়। অন্যদিকে নাগরিক স্বাধীনতার মধ্যে রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিশ্বাস, মানবাধিকার সংস্থাসহ সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা, আইনের শাসন ও বিচারব্যবস্থা, ব্যক্তিস্বাধীনতা।

রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা—দুই মানদণ্ডে বাংলাদেশের রেটিং ৭-এর মধ্যে ৫। ফলে ফ্রিডম রেটিংয়েও বাংলাদেশ ৫ পেয়েছে। এ হিসাবে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দিক দিয়ে ‘আংশিক মুক্ত’। ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে যেসব দেশ ও অঞ্চলের স্কোর ১ থেকে ৩৪-এর মধ্যে, তাদের ‘মোটেও স্বাধীন নয়’, ৩৫ থেকে ৭১ হলে তাদের ‘আংশিক স্বাধীন’ এবং ৭২-এর বেশি হলে তাদের ‘স্বাধীন’ হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ আংশিক স্বাধীন দেশের তালিকায় থাকলেও অবস্থান নিচের দিকে। স্বাধীন দেশের তালিকা থেকে অনেক দূরে, আর স্বাধীন নয় এ রকম দেশের তালিকার খুব কাছাকাছি। আর পাঁচ ধাপ নামলেই বাংলাদেশ পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী দেশের কাতারে চলে যাবে। অন্যদিকে স্বাধীন দেশের কাতারে যেতে অনেক দূর পথ পাড়ি দিতে হবে।

এ কথা ঠিক যে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক শাসনের অবনতি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো যেসব দেশের দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য আছে, সেসব দেশও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছে। এসব দেশের শাসকেরা এমন সব নীতি ও কর্মসূচি নিয়েছেন, তা জাতিগত সংখ্যালঘু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার খর্ব করছে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কিছুটা অগ্রগতি আছে, অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের যে সর্বজনীন রীতি, সেটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসের কিনারে।

এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতার বাধাগুলো দূর করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নাগরিক অধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাচর্চার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী আইনও প্রত্যাহারের বিকল্প নেই।