গণপরিবহনে ‘হাফ পাস’

সম্পাদকীয়

গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানো নিয়ে কিছুদিন আগে সড়কে একদফা নৈরাজ্য চলেছে। অনেক পরিবহনমালিক-শ্রমিক সরকার-নির্ধারিত বর্ধিত ভাড়ার চেয়ে বেশি দাবি করায় যাত্রীদের সঙ্গে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটি রুটে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কিছু বাসমালিক ও শ্রমিককে জরিমানা করার পর অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার প্রবণতা কমলেও নতুন বিরোধ দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস বা অর্ধেক ভাড়া নিয়ে।

শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপন বা ঘোষণা না থাকলেও স্বাধীনতার আগে থেকে এটি চালু আছে। উনসত্তরে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন করেছিল, তাতে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, স্টিমার ইত্যাদিতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার কথা বলা হয়। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের পর পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়টি মেনে নেয়। স্বাধীনতার পরও এটি চালু ছিল। এমনকি সম্প্রতি বাসভাড়া বাড়ানোর আগে অনেক গণপরিবহন ঢাকা শহরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিত। কিন্তু ভাড়া বাড়ানোর পর গণপরিবহনগুলো সেই সুবিধা কেড়ে নেয়, যা সম্পূর্ণ অন্যায়। তারা যুক্তি দেখায় যে সরকারের সঙ্গে বাসভাড়া বাড়ানো নিয়ে যখন চুক্তি হয়, তখন শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার কথা বলা হয়নি।

শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া নেওয়া, না–নেওয়া নিয়ে গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবরোধ, বাস ভাঙচুর, পরিবহনকর্মী ও শিক্ষার্থীদের মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। আজিমপুর এলাকায় এক ছাত্রী অর্ধেক ভাড়া দিতে গেলে তাঁর প্রতি চরম দুর্ব্যবহার করেছেন ওই বাসের চালক ও তাঁর সহকর্মী। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালানো ও মিছিল থেকে এক আন্দোলনকারী ছাত্রকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিস্ময়কর হলো, গত কয়েক দিন রাজপথে বিশৃঙ্খল অবস্থা চললেও সরকার নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ফলে নিত্যযানজটের শহরে যাত্রীসাধারণ সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলেছে, শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়টি দাবি নয়, অধিকার। স্বাধীনতার আগে থেকে তারা যে অধিকার ভোগ করে এসেছে, তা থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না। তাদের মতে, ঢাকা শহরে মোট যাত্রীর মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাঁদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিলেও পরিবহনমালিকদের লোকসান দিতে হবে না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিলে পরিবহনশ্রমিকদের যে পরিমাণ আয় কমে যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁরা লাভবান হবেন পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ হলে।

শিক্ষার্থীদের দাবি নতুনও নয়, অযৌক্তিকও নয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সপ্তাহ ও মাসভিত্তিক আলাদা ভাড়া নির্ধারিত হয়, যা রুটভিত্তিক ভাড়ার চেয়ে অনেক কম। শিক্ষার্থীরা ক্লাস করার জন্য সপ্তাহে পাঁচ–ছয় দিন বাসে চড়েন। সে ক্ষেত্রে তাঁরা যৌক্তিকভাবেই অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার দাবি করতে পারেন। করোনার দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হয়েছে। এখন যদি পরিবহনভাড়া নিয়ে তাঁদের রাজপথে থাকতে হয়, তাহলে সেই ক্ষতি পূরণ করা কখনো সম্ভব হবে না।

আশা করি, দেরিতে হলেও সরকারের ঘুম ভাঙবে এবং পরিবহনমালিকদের সঙ্গে বসে তাঁরা সমাধানের একটি সূত্র বের করবেন।