গণহারে মাদকের মামলা খালাস

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্রে ‘জনতার আদালত’ শব্দবন্ধটি ব্যাপক জনপ্রিয়। এ অদৃশ্য আদালতে বিচারক থাকে না। কাঠগড়া থাকে না। উকিল–মোক্তার থাকে না। কিন্তু এই আদালতে অপরাধী আইনের ফাঁক গলে বের হতে পারে না এবং এখানে অপরাধীর যথাযথ বিচার হয়—এমন একটি জনশ্রুতি প্রতিষ্ঠিত আছে। কিন্তু আইন বলে, জনতার আদালত বলে কিছু নেই। যেকোনো অপরাধের বিচার একমাত্র সংবিধানের আলোকে প্রণীত বিদ্যমান আইনের মাপকাঠিতেই সম্ভব এবং সেই মাপকাঠি ব্যবহার করার দায়িত্ব ও অধিকার রাষ্ট্র নিযুক্ত সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিসম্পন্ন বিচারকের। সমস্যা হলো, যে মনুষ্যযন্ত্র বা যাঁরা আইন প্রয়োগ করেন এবং অভিযুক্তকে কাঠগড়ায় সোপর্দ করেন, সেই ব্যক্তিরা যদি ঠিক ঠিক প্রমাণাদি দাখিল করতে ব্যর্থ হন, তাহলে বিচারকের সামনে অভিযুক্তকে খালাস দেওয়া ছাড়া পথ থাকে না। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো, তাঁদের সেই ব্যর্থতা কি আসলেই ব্যর্থতা, নাকি তা ইচ্ছাকৃত অনিয়ম বা গাফিলতির ফল, তা প্রমাণের সুযোগ খুবই কম থাকে।

নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে ‘ডার্ক জাস্টিস’ নামের যে ক্রাইম ড্রামা সিরিজটি প্রচারিত হতো, সেখানে নিকোলাস মার্শাল নামের একটি চরিত্র ছিল। মার্শাল একজন বিচারক। মার্শাল ব্যক্তিগত বিবেচনায় বুঝতে পারতেন, তিনি যাঁর বিচার করতে বসেছেন, সেই অভিযুক্ত আসলেই অপরাধী। কিন্তু তাঁকে দণ্ডিত করতে যে প্রমাণ দরকার, তা রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি পেশ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বিচারক বাধ্য হয়ে অভিযুক্তকে ‘কেস ডিসমিস’ বলে খালাস দিয়ে দিতেন। খালাসপ্রাপ্ত লোক বিচারকক্ষ ছাড়ার সময় মার্শাল তাঁর উদ্দেশে বলতেন, ‘আইন অন্ধ হলেও অন্ধকারে দেখতে পায়।’ এরপর মার্শাল নিজেই পরিচয় গোপন করে সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করে পরে অপরাধীকে সাজার আওতায় আনতেন।

বাংলাদেশের আইন–আদালত কোনো টিভি সিরিজ নয়। এখানে ‘ডার্ক জাস্টিস’ নিকোলা মার্শালের অস্তিত্বও নেই। ফলে এখানে আইনের ফাঁক দিয়ে খালাস পাওয়া অভিযুক্তকে আবার প্রমাণ সাপেক্ষে দণ্ডিত করা অসম্ভব। অতি উদ্বেগ ও আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় হলো, মাদক কারবারে জড়িত ভয়ানক আসামিরা শুধু কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। এতে আবার তাঁরা পুরোনো কারবারে জড়াচ্ছেন।

গত ২০ বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়ের করা মামলার মধ্যে ২৩ হাজার ৫৩৫ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়ে গেছেন। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ২৬ হাজার ১৩৮। এই আসামিরা মাদকসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বলে মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল। কিন্তু এজাহার ও তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষী হাজির করায় ব্যর্থতাসহ নানা কারণে শেষ পর্যন্ত অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। জব্দতালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, বাদী ও অভিযানকারীদের বক্তব্যে অমিল থাকার কারণেও অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি। আবার অনেক কর্মকর্তা মাদক উদ্ধারে মনোযোগী হলেও তদন্তে কম আগ্রহ দেখিয়েছেন। ফলে আদালতে দায়সারা অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

দেখা যাচ্ছে, ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৬ হাজার ৯০৭টি। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক (৫০ দশমিক ১৭ শতাংশ) মামলা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও রাষ্ট্রপক্ষ। মৌমাছির কামড়ের ব্যথার দাওয়াই যেমন মধুর মধ্যে দেওয়া আছে, তেমনি এই সমস্যার সমাধান খালাসের রায়ের মধ্যেই আছে।

অধিকাংশ মামলার রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণ দেন। তদন্তের নানা দুর্বলতার কথা তুলে ধরেন। গ্রহণযোগ্য সাক্ষী হাজির করতে না পারার কথা বলেন। মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতির কথাও পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। এ বিষয়গুলো আমলে আনলেই মাদক মামলার আসামিরা খালাস পাবেন না। কিন্তু সেটি করতে সবার আগে দরকার সদিচ্ছা। দরকার ক্ষমতাশালীর আদেশ ও অর্থের প্রলোভনকে উপেক্ষা করার দৃঢ় মনোবল।