ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাসীনতার শেষ কবে

সম্পাদকীয়

নিছক উচ্চ বেতনের চাকরি অর্জন ও পদোন্নতির শর্ত পূরণকারী কাগুজে সনদভিত্তিক জ্ঞানস্পৃহা নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষের প্রধান পরিমাপক হলো নতুন নতুন জ্ঞান ও নতুন চিন্তার প্রসার। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি থেকে শিল্প-বাণিজ্য, প্রশাসনকৌশল থেকে উন্নয়ননীতি, যেকোনো ক্ষেত্রেই গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত প্রয়োগের মধ্যেই সর্বাঙ্গীণ অগ্রগতি নিহিত। আর বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই জ্ঞানচর্চার আঁতুড়ঘর। কিন্তু বাংলাদেশের অধুনা বাস্তবতা বলছে, যা না থাকলেও চলে এবং যা না থাকলে কারও কিছু যায় আসে না, তার নাম গবেষণা। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক নিয়োগ ও উন্নয়ন অবকাঠামোর বিষয়ে যতখানি তৎপর, গবেষণা নিয়ে মাথা ঘামাতে তার সিকি ভাগও আগ্রহী নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি গবেষণাকেন্দ্রের কার্যক্রম স্রেফ আর্থিক অভাবে পড়ে বন্ধ হওয়ার পেছনে কর্তৃপক্ষের সেই অনাগ্রহ বড় ভূমিকা রাখছে।

দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠিত গবেষণাকেন্দ্র ‘সেন্টার ফর ব্যাংকিং এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এসএমই ম্যানেজমেন্ট’, সেন্টার ফর প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসোর্স ইন স্ট্র্যাটেজিক হিউম্যান রিসার্চ ম্যানেজমেন্ট, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ অন বিজনেস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, আরবরি কালচার সেন্টারসহ মোট ৯টি গবেষণাকেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।

সাধারণত বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা ও বিভাগের নিজস্ব অর্থায়নে প্রতিষ্ঠা পায় এসব গবেষণাকেন্দ্র। পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নেই কেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার রীতি রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে ৫৪টি গবেষণাকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটেছে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া ৯টি গবেষণাকেন্দ্রে। এসব কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনে খোলা হয়েছে ঠিকই; কিন্তু বাজেটের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় বরাদ্দ পাচ্ছে না। এগুলো যে বিভাগের উদ্যোগে খোলা হয়েছে, তারাই তা পরিচালনা করছে। এখন তাদের হাতে তহবিল নেই, ফলে কেন্দ্রগুলোও ‘বেকার’ হয়ে গেছে।

অন্যদিকে, গবেষণার দিক থেকে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া কেন্দ্রগুলো কি ভালো আছে? না, নেই। এসব কেন্দ্রে প্রতি অর্থবছরে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। ফলে অধিকাংশ কেন্দ্রই প্রত্যাশা অনুযায়ী গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলতি অর্থবছরে ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল গবেষণা খাতে। আগামী অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ১৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। এত বড় একটি বিদ্যাপীঠের গবেষকদের কার্যক্রম পরিচালনায় এই বরাদ্দ অতি অপ্রতুল। যে কয়টি খাতে সবচেয়ে বেশি বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেখানে গবেষণার খাতটি বলতে গেলে অনেক পিছিয়ে।

গবেষণার বিষয়ে এই উদাসীনতার কারণেই যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উল্লেখ করা প্রথম ৮০০টির মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। এ নিয়ে যখন গোটা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা দেখা যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে এ তালিকা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান ‘কারা কী করল, এগুলো এখন একেবারেই দেখি না’ বলে অধিকতর হতাশাপ্রদায়ক বক্তব্য দিয়েছেন। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহ্য হারাবে। সে কারণে বন্ধ হওয়া গবেষণাকেন্দ্রগুলোকে বাজেটের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের জন্য তহবিল সরবরাহ করতে হবে। অন্য গবেষণাকেন্দ্রগুলোও যাতে ফলপ্রসূভাবে চালু থাকে, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে।