তাঁকে অমর করে রাখবে একুশের সেই গান

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ৮৮ বছর বয়সে চলে গেলেন। এটিকে কোনোভাবে অপরিণত বয়স বলা যাবে না। তারপরও আমরা তাঁর শূন্যতা অনুভব করব। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন তাঁর দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ছিলেন সাংবাদিক, কবি, কথাসাহিত্যিক ও গীতিকার। তিনি পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশের দশকে সাংবাদিতা শুরু করে আজীবন সেই পেশায় যুক্ত ছিলেন। কখনো বার্তা বিভাগে সহসম্পাদক হিসেবে, কখনো কলামযোদ্ধা হিসেবে, আবার কখনো সম্পাদক হিসেবে। তিনি ডান-বাম-মধ্য সব মতের পত্রিকায় কাজ করেছেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণার পর তাঁর সম্পাদিত সান্ধ্য দৈনিক আওয়াজ–এ প্রথম সেই কর্মসূচির পুরোটা প্রকাশিত হয় শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতায় পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি কলকাতায় দৈনিক আনন্দবাজার যুগান্তর পত্রিকায়ও কলাম লিখতেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দৈনিক জনপদ বের করেন। ১৯৭৪ সালে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। কিন্তু তাঁর হৃদয় ও মননে সদা জাগরূক ছিল বাংলাদেশ; যার প্রতিফলন থাকত তাঁর কলামে, রাজনৈতিক ভাষ্যে।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর বহুমাত্রিক পরিচয়ের মধ্যেও যে পরিচয় গোটা জাতিকে আন্দোলিত ও প্রাণিত করেছে তা হলো, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান। এই গান কেবল একুশের অনুষ্ঠানে নয়, সারা বছরই গীত হয় নানা উপলক্ষে। আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র পর আর কোনো গান এত জনপ্রিয়তা পায়নি। এই একটি গানের জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তাঁর এই গান গীত হবে। এ প্রসঙ্গে এ কথাও উল্লেখ করা জরুরি যে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর এই গানের প্রথম সুরকার ছিলেন আবদুল লতিফ। সে সময় গানটি এত জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটি গীত হওয়ার পর জনচিত্তকে নাড়া দেয়।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাসও লিখেছেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, সম্রাটের ছবি, ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা, বাঙালি না বাংলাদেশি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রথম যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন, তারও অগ্রসারিতে ছিলেন আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী। পলাশী থেকে ধানমন্ডি কিংবা ইতিহাসের রাখাল রাজা তারই স্বাক্ষর বহন করে।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী সূচনা সংখ্যা থেকে বহু বছর প্রথম আলোয় কলাম লিখেছেন। এর আগে ভোরের কাগজ-এও তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন। তাঁর রাজনৈতিক মত ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অনেকেই একমত না হতে পারেন, কিন্তু তাঁর লিখনশৈলীতে এক আশ্চর্য জাদু ছিল, যা পাঠককে সহজে আকর্ষণ করত। বাংলাদেশে কলাম লেখাকে জনপ্রিয়ও করেছেন তিনি।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদকসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু সেসব পুরস্কার ছাপিয়ে তিনি একুশের গানের জন্য বাংলাদেশের গণমানুষের মধ্যে যে স্থান করে নিয়েছেন, তার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। বাংলা ভাষা যত দিন থাকবে, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর লেখা অমর একুশের গানটিও থাকবে। তাঁর প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। তাঁর প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।