বাংলার গ্রাম-প্রকৃতির অনন্য এক নিদর্শন হচ্ছে তালগাছ। আকাশ ছুঁই ছুঁই তালগাছ সেই আদিকাল থেকে গ্রামবাংলার শোভা বাড়িয়ে এসেছে। তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে—রবীন্দ্রনাথের এ কবিতা তো আমাদের ছেলেবেলারই অংশ। যদিও গ্রামের বিস্তীর্ণ ধানখেতের কোনায় কিংবা রাস্তার ধারে তালগাছের সারি আর তাতে ঝুলন্ত বাবুই পাখির বাসার নয়নাভিরাম দৃশ্য এখন দুর্লভ। কারণ, প্রকৃতির ধারাবাহিক বিনাশের মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে তালগাছও। তা ছাড়া মৌলভীবাজারের হাসিম মিয়ার মতো তালগাছপ্রেমী কৃষকও এখন আর কোথায়?
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আখাইলকুরা ইউনিয়নের রায়পুর গ্রামের হাসিম মিয়া (৮০) প্রায় ৫০ বছর ধরে নিরলসভাবে তালগাছ লাগিয়ে গেছেন। অথচ বেড়ে উঠতে সময় লাগে বলে তালগাছ লাগাতে চায় না মানুষ। সদর উপজেলার একাটুনা-নতুন ব্রিজ সড়কের দুই পাশে প্রায় সাত কিলোমিটারজুড়ে কোথাও একলা, কোথাও সারি বাঁধা হাসিমের লাগানো গাছগুলো। কোনোটিতে তালও ধরছে। মানুষ সেই তাল নিয়েও যাচ্ছে। আগামী কয়েকটি প্রজন্ম এসব তালগাছের সুফল ভোগ করবে।
কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে তারুণ্যের সময় নিজ তাগিদে তালের বীজ রোপণ করা শুরু করেন হাসিম। ভাদ্র মাসে তাল পাকার সময় ছালার ব্যাগে করে তালবীজ নিয়ে বের হতেন। মানুষের কৌতূহলী চোখের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি নীরবে সড়কের পাশে বীজ রোপণ করে দিতেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে প্রকৃতির এমন সাধনা তিনি করে গেছেন। তবে শুধু তালগাছই নয়, অন্যান্য গাছও লাগিয়েছেন তিনি। গাছপালার প্রতি তাঁর রয়েছে আলাদা মায়া-মমতা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতে নিহত মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। কৃষকেরাই এর শিকার হচ্ছেন বেশি। কারণ, যে তালগাছ বজ্রপাত থেকে তাঁদের নিরাপত্তা দেয়, সেটি এখন নেই বললেই চলে। নানা বাস্তবতায় হারিয়ে গেছে নদীপথ, ফলে ডোঙ্গা নৌকার চাহিদাও নেই। তালগাছ থেকে বানানো এ নৌকা ছিল কৃষিসমাজেরই অংশ। যেখানে কৃষির ঐতিহ্যই তার রূপ-রস-গন্ধ হারিয়ে বসেছে, সেখানে তালগাছের কথা আলাদা করে ভাবার কে আছে।
বছর তিনেক আগে হাসিম মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে শয্যায়। স্মৃতিবিভ্রাটের কারণে কোনো কিছুই মনে করতে পারেন না। তবে তালগাছ নিয়ে কথা বললে তাঁর চেহারায় একধরনের উজ্জ্বল আলো ফুটে ওঠে। কিন্তু কিছুই বলতে পারেন না। কোনো ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি বা রাষ্ট্রীয় সম্মানের আশাও করেননি, পাননিও। এ জন্যই বোধ হয় এত দশক ধরে অসাধারণ ও মূল্যবান কাজটি করে যেতে পেরেছেন। কোনো প্রাপ্তির আশা ছাড়া সমাজ, প্রাণ ও প্রকৃতির জন্য কিছু করার মানুষ এখন বিরল। আমরা হাসিম মিয়াকে অভিবাদন জানাই। ঘুণে ধরা এ সময়ে তিনি হয়ে উঠুন সমাজের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।