তাহলে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকার প্রয়োজন কি?

সম্পাদকীয়

দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পৌরসভাগুলোতে জেলা প্রশাসক বা ডিসিদের নজরদারি আগে থেকেই ছিল। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রথম শ্রেণির ১৯৪টি পৌরসভায়ও ডিসিদের নজরদারির ক্ষমতা দেওয়ার যে প্রস্তাব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় দিয়েছে, তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসন কীভাবে পরিচালিত হবে, তার নির্দেশনা আছে। কিন্তু আমাদের পূর্বাপর সরকারগুলো সেই নির্দেশনা মেনে চলেছে, এমনটি বলা যাবে না।

উপজেলা পরিষদ আইনে ১২টি মন্ত্রণালয়ের ১৭টি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঠপর্যায়ে উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পরিপত্র জারি করে এসব বিভাগের কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য গঠিত কমিটিগুলোতে ইউএনওরা সভাপতিত্ব করে থাকেন। এ নিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আপত্তিও আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে উপজেলা পরিষদ অনেকটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা সেখানে আলংকারিক প্রধান।

প্রথম শ্রেণির পৌরসভাগুলোতে ডিসিদের নজরদারির ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব বলেন, ডিসিরা এখন ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন করতে পারেন। কিন্তু প্রথম শ্রেণির ১৯৪টি পৌরসভায় ডিসিদের পরিদর্শনের এখতিয়ার নেই। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো প্রস্তাবটি পাস হলে ডিসিরা পৌরসভা পরিদর্শন করতে পারবেন। এতে পৌরসভার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

উল্লেখ্য, গত ১০ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভায়’ দেশের পৌরসভাগুলোর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে পৌরসভা পরিদর্শনের ক্ষমতা জেলা প্রশাসকদের দেওয়ার দাবি ওঠে। পৌর কর্মীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য বকেয়া পরিশোধ, নাগরিকদের যথাযথ সেবা প্রদান এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ত্বরান্বিত করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।

বিভাগীয় কমিশনার সমন্বয় সভায় যেসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর প্রতিকার প্রয়োজন। আমাদের অধিকাংশ পৌরসভা আর্থিকভাবে অসচ্ছল এবং তারা কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। অনেক পৌরসভা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও ঠিকমতো দিতে পারে না। এর কারণ রাজনৈতিক কারণে অনেক পৌরসভা করা হয়েছে, যার স্থানীয় বাসিন্দাদের সেবা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে তারা করও আদায় করতে পারে না।

এই বাস্তবতায় পৌরসভাগুলোতে ডিসিদের নজরদারি কোনো কাজে আসবে বলে মনে করি না। পৌরসভাগুলোর আর্থিক সামর্থ্য বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারের নীতি-পরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারের রাজস্বের একটি অংশ স্থানীয় সরকার সংস্থাকে দিতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে। সব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।

জনমনে ধারণা আছে, সরকার আমলাতন্ত্রকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর স্থান দিয়েছে। উপজেলা পরিষদের মূল ক্ষমতা প্রশাসনের হাতে রাখা, জেলা পরিষদ অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে চালানো এবং পৌরসভাগুলোর কাজে ডিসিদের নজরদারির ক্ষমতা—সবাই করা হয়েছে বা হচ্ছে একই উদ্দেশ্য সামনে রেখে।

গণতান্ত্রিক শাসনের মূল কথা যে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, স্থানীয় শাসন বা সরকার সংস্থাগুলোকে অকার্যকর করে তা কখনো সম্ভব নয়। পৌরসভাগুলোর অসচ্ছলতার দোহাই দিয়ে সেখানে ডিসিদের নজরদারির ব্যবস্থা হবে স্থানীয় সরকার সংস্থার এই মাধ্যমটিকে পুরোপুরি অকেজো করে রাখা।