দুদকের তদন্তে কতটা ভরসা করা যায়

কক্সবাজার ডিসি অফিসের সার্ভেয়ার আতিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার এবং তাঁর কাছ থেকে ২৩ লাখ টাকা জব্দ করার ঘটনাকে আমরা কীভাবে দেখব? দেশের বাস্তব অবস্থার নিরিখে জনমনে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ কাজ কি এবারই তিনি প্রথম করেছেন, না আগেও অনেকবার করেছেন। এটি কি ব্যক্তিপর্যায়ের দুর্নীতির অংশ, নাকি তা মেগা উন্নয়ন প্রকল্প ঘিরে থাকা মেগা দুর্নীতি!

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ব্যাগে ভরে ২৩ লাখ টাকা নিয়ে ঢাকায় ধরা পড়েছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ (এলএ) শাখার সার্ভেয়ার আতিকুর রহমান। পরে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তাঁকে কক্সবাজারে ফেরত পাঠানো হয়। গত শুক্রবার রাতে তাঁকে পুলিশে দিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ প্রথম আলোকে বলেছেন, সার্ভেয়ার আতিকুর এ টাকার বৈধ কোনো উৎস দেখাতে পারেননি। এ টাকা নিয়ে তিনি উড়োজাহাজে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। কার কাছে যাচ্ছিলেন, এত টাকা তিনি কোথায় পেলেন, এসব বিষয় তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

এখন প্রশ্ন হলো আসলেই কি তদন্তে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে? সেই তদন্ত কে করবেন? এই সম্পাদকীয় লেখা পর্যন্ত আতিকুরের নামে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু দুদকের যে অতীত রেকর্ড, তাতে তার তদন্তের ওপর ভরসা করা কঠিন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, কক্সবাজারে সরকারের তিন লাখ কোটি টাকার ৭২টি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এর আগে দুদকের তিনটি তদন্তে ভূমি অধিগ্রহণে মোট ৭৮ কোটি টাকা দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। এ দুর্নীতির তদন্তে নেতৃত্ব দেওয়া দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে প্রথমে বদলি এবং পরে গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ সরকারি কর্মকর্তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের যে সুযোগ পেয়ে থাকেন, তা-ও তাঁকে দেওয়া হয়নি।

২০১৭ সালে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে কক্সবাজারের সাবেক ডিসি মো. রুহুল আমিন ও এডিসি (রেভিনিউ) জাফর আলমকে কারাগারেও যেতে হয়েছিল। মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণ করা জমি, চিংড়িঘের, ঘরবাড়িসহ অবকাঠামোর বিপরীতে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয় ২৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৫টি অস্তিত্বহীন চিংড়িঘের দেখিয়ে নানা কৌশলে ১৯ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার ৩১৫ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।

জনমনে এ ধারণা জোরালো যে রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে সুনামের সঙ্গে কাজ করা একজন কর্মকর্তাকে দুদক চাকরিচ্যুত করেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ন্যায়বিচার কতটুকু আশা করা যায়, তা তর্কসাপেক্ষ। তবে সার্ভেয়ার আতিকুরের কাছ থেকে জব্দ করা অর্থের উৎসসহ তাঁকে এ অর্থ সংগ্রহে সহযোগিতাদানকারী ও অর্থের ভাগীদারদের আদ্যোপান্ত জনসমক্ষে প্রকাশ করা জরুরি। দায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিকে শাস্তির আওতায় আনা আরও জরুরি। চুনোপুঁটি বা বাহকদের ধরে রাঘববোয়ালদের ছেড়ে দিলে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে যথেচ্ছ দুর্নীতি চলতেই থাকবে। সরকার যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা জানাচ্ছে, তখন ডিসি অফিসের একজন সার্ভেয়ারকে ২৩ লাখ টাকা নিয়ে উড়াল দিতে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেককে অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়তে দেখা যাচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সবুজসংকেত ছাড়া তাঁরা এমন সুযোগ পেয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার স্বার্থেই এ ২৩ লাখ টাকার রহস্য উন্মোচন জরুরি। আর দুদকের স্বচ্ছতার স্বার্থেই সংস্থাটির চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের জমা দেওয়া ১৫৫ জনের নামসংবলিত দুর্নীতির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা বিধেয়।