দুর্যোগকালে গণমাধ্যম

সম্পাদকীয়

যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীন গণমাধ্যম অপরিহার্য। স্বাধীন গণমাধ্যমের পূর্বশর্ত হলো ভয় ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব পালন। ভয় হতে অভয় পথে চলার স্বাধীনতা। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২-এর খ উপধারায় আছে, ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হইল।’ একই অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ‘আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধের’ শর্ত থাকলেও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা পুরোপুরি নিঃশর্ত।

সংবাদক্ষেত্র কিংবা গণমাধ্যমের এই স্বাধীনতা স্বাভাবিক সময়ে যতটা প্রয়োজন; যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক বা মানবিক দুর্যোগের সময় প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি। বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব এখন কোভিড-১৯ নামের মহাদুর্যোগের শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে বলছে বৈশ্বিক মহামারি। গত বছরের মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই মহামারি আমাদের জনজীবন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনীতিতে যে মারাত্মক অভিঘাত তৈরি করেছে, তা মোকাবিলা করতে হলে সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সংহতি ও সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে জরুরি হলো অবাধ তথ্যপ্রবাহ তথা গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বলেছেন, যে দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। তাঁর প্রবাদপ্রতিম এই বক্তব্য করোনা মহামারিসহ অন্যান্য দুর্যোগ সম্পর্কেও সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষ সঠিক তথ্য পেলে দুর্যোগ মোকাবিলা সহজতর হয়। প্রশ্ন উঠবে সঠিক তথ্য কোনটি। ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকার করোনা নিয়ে ‘মিথ্যা ও ভুল তথ্য’ প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করেছিল। কিন্তু আদালত তা নাকচ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশে এ রকম কোনো আবেদন না জানানো হলেও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিভিন্ন সময় ‘ভুল’ তথ্য নিয়ে শোরগোল তুলে থাকেন।

করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকার লকডাউন, জন চলাচলে বিধিনিষেধ, ক্ষতিগ্রস্ত খাতের জন্য প্রণোদনা ও হতদরিদ্র মানুষের জন্য যে আর্থিক প্রণোদনা ও সহায়তা ঘোষণা করেছে, কোনো গণমাধ্যম তার বিরোধিতা করেছে বলে আমাদের জানা নেই। কিন্তু সরকারের এই সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যে বেঠিক কাজ হয়, অনিয়ম-দুর্নীতি হয়, সেসব তুলে ধরা নিশ্চয়ই ভুল তথ্য ছড়ানো নয়। বরং সাহেদ-সাবরিনা কেলেঙ্কারিসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অনিয়ম গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় সরকার ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে পেরেছে। একইভাবে করোনাকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, লোক নিয়োগ ও যন্ত্রপাতি কেনায় যেসব অনিয়ম হয়েছে, তা গণমাধ্যমে আসায় দুর্নীতিবাজদের আঁতে ঘা লাগলেও দেশ ও জনগণ উপকৃত হয়েছে। তাই গণমাধ্যমের অনুসন্ধান ও সত্য প্রকাশকে ভিন্ন চোখে দেখার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকারের ফল যে কত মারাত্মক হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের একগুঁয়েমি তার প্রমাণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালে করোনা মহামারি নিয়ে গণমাধ্যমের তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে দেশটিতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন। বিপরীতে জো বাইডেন প্রশাসন গণমাধ্যমের তথ্য ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নেওয়ায় দ্রুত পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে।

সরকারের মন্ত্রীরা প্রায়ই বলে থাকেন, তাঁরা সরকারকে গণমাধ্যমের মুখোমুখি করতে চান না। সহযোগিতা চান। আমরা চাই কাজেও এর প্রতিফলন ঘটুক।