প্রাণ ও পরিবেশ ধ্বংস করে উন্নয়ন নয়

আন্তর্জাতিক বন দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের বন ও প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে প্রথম আলোয় ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে যে তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। বাংলাদেশের প্রধান তিন বনভূমিসহ প্রায় সব প্রাকৃতিক বনই দখল ও দূষণের শিকার।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের আকার দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে। ১৯০৪-২৪ সালে এ বনভূমির আয়তন ছিল ৭ হাজার ১৪২ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫-১৬ সালে সেটি ৬ হাজার ৮৭১ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছরে বনের আকার আরও ছোট হয়েছে। সুন্দরবনের পাশেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প। কেবল বিদ্যুৎ প্রকল্প নয়, এর আশপাশে বেসরকারি উদ্যোগে আরও অনেক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা সুন্দরবনের ওপর মারাত্মক অভিঘাত তৈরি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সুন্দরবনের আকার ছোট হওয়ার অর্থ সেখানকার বনজ ও প্রাণিজ সম্পদ কমে যাওয়া। বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বনে ৫২৮ প্রজাতির বৃক্ষ ও লতাগুল্ম আছে, আছে ৩০০ প্রজাতির পাখি। ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী সুন্দরবনে চরে বেড়ায়। সুন্দরবনের নদী-খালে ২৫০ প্রজাতির মাছ আছে। আছে বহু প্রজাতির কীটপতঙ্গ, কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক। আছে নানা ধরনের ছত্রাক, শেওলা।

প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে যে ঘূর্ণিঝড় হয়, তা থেকে বাংলাদেশকে সুন্দরবনই রক্ষা করে। এ কারণে একে বলা হয় প্রাকৃতিক ঢাল। এখন আমরা যদি উন্নয়নের নামে এ প্রাকৃতিক ঢাল দুর্বল করে ফেলি, তাহলে সেখানকার গাছপালা তো বটেই, পশুপাখিও মরে যাবে। সুন্দরবনের অস্তিত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের অস্তিত্বই নির্ভরশীল। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলও উজাড় করা হচ্ছে কথিত উন্নয়নের নামে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, রাঙামাটিতে কাপ্তাই হ্রদের জলাভূমি ধরে ৪০ কিলোমিটার দূরে সীতা পাহাড় নামে যে বিশাল বনভূমি ছিল, সেখানে ফলবাগান, জনবসতি, হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতেও অনেক বন ও পাহাড় ধ্বংস করে উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে স্থানীয়দের আপত্তি সত্ত্বেও। অন্যদিকে তৃতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চলখ্যাত মধুপুরের অবস্থা আরও করুণ। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৫ হাজার একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা মধুপুরে এখন বনাঞ্চল আছে মাত্র ৯ হাজার একর। বাকিটা দখল হয়ে গেছে।

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউটের (ডব্লিউআরআই) হিসাবমতে, ২০০২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাকৃতিক বন উজাড় হয়েছে। আর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এ হার ৯ শতাংশের বেশি। দেশের মোট বনভূমির ৪০ শতাংশ রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে। অন্যদিকে একই সময়ে সারা দেশে যে পরিমাণে বৃক্ষ বেড়েছে, তার ৭৮ শতাংশ চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে। সংস্থা দুটি বলছে, ওই নতুন বৃক্ষের বেশির ভাগই প্রাকৃতিক বন কেটে ও কৃষিজমিতে রোপণ করা ফলবাগান ও কাঠবাগান।

অতএব, আমরা যদি প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করতে না চাই, অবিলম্বে এসব বনাঞ্চল দখল বন্ধ করতে হবে। মানুষ ও টেকসই উন্নয়নের স্বার্থেই আমাদের বন ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ আশা করি।