ফরাসি পাল্টা-বিপ্লব: কার চোখে কেমন
পশ্চিমা বিশ্বে রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদীদের বিজয়ের ঢেউ ঘুরিয়ে দিয়ে ফ্রান্সে জিতে গেলেন ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। বিশ্বের গণমাধ্যমে বিশ্লেষকেরা প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোকপাত করেছেন। এখানে তার নির্বাচিত কিছু অংশ তুলে দেওয়া হলো

রজার কোহেন
ইউরোপের পুনরুজ্জীবন
নিউইয়র্ক টাইমস
ম্যাখোঁর বিজয়ের কারণ অনেক। তিনি দেখিয়েছেন, বর্ণবাদ ও ইউরোপ-বৈরী উগ্র জাতীয়তাবাদ নির্বাচন জিতে নেবে—এমন দেশ ফ্রান্স হবে না। তিনি ইউরোপীয় ভাবধারাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করছেন এবং ফ্রান্স ও জার্মানি মিলে ইউরোপীয় আদর্শবাদের পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছেন। যেসব খুদে ইংরেজ ব্রিটেনকে ইইউয়ের বাইরে নিতে ভোট দিয়েছে, তাদের বকেও দিয়েছেন। পাশাপাশি কঠিন করে তুলেছেন ব্রেক্সিটের পক্ষে দর-কষাকষি।
সবকিছুর ওপরে, আপন বুদ্ধিমত্তা ও শিষ্টতা দিয়ে, সংস্কৃতি ও খোলা মন নিয়ে ম্যাখোঁ স্থূলতা ও অভদ্রতার বিরুদ্ধে খুবই দরকারি এক দেয়াল তুলেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওভাল দপ্তর থেকে যে হাঁদামি ও মানসিক গোঁড়ামি চুইয়ে পড়ছে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চালচলন বিষিয়ে তুলেছে, ম্যাখোঁ তার বিরুদ্ধেও এক প্রতিষেধক।
ফ্রান্স যদি আবারও বিকশিত হয়, ইউরোপও এর সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হবে। আর তা স্বৈরতান্ত্রিক-জাতীয়তাবাদী ধারার বিরুদ্ধে শক্তিশালী বাধা হিসেবে দাঁড়াবে। যে ধারায় আছেন ফ্রান্সের খোলস বদলানো লা পেন, ব্রিটেনের জাতিবিদ্বেষী ভাঁড় নিগেল ফারাজ (ট্রাম্পের বন্ধু), মস্কোর পুতিন, তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং অবশ্যই আছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট স্বয়ং।

দ্য গার্ডিয়ান
সাইমন টিসডাল
ডানপন্থী জোয়ার থামিয়ে দিলেন
ম্যাখোঁর বিজয় উদারতাবাদের সুনাম এনে দিল আবার। আর এর পুনর্বাসন হলো তখনই, যখন তা খুব বেশি দরকার হয়ে পড়েছিল।
মাসের পর মাস, প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদেরা ইউরোপের ক্ষমতার অলিন্দে কাঁচুমাচু হয়ে লোকরঞ্জনবাদী জনতার গর্জায়মান দাবিদাওয়া শুনেছেন।
বিশ্লেষকেরা ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সামাজিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান এবং স্বৈরতান্ত্রিক জামানায় ফিরে আসার অনুমান জানিয়ে যাচ্ছিলেন। আর যুক্তরাষ্ট্রে, ট্রাম্প-সমর্থকেরা উদ্যাপন করেছিল ‘ঐতিহাসিক’ রদবদলের মুহূর্ত। কিন্তু ফ্রান্সে তা ঘটেনি। দেখা গেল, ম্যাখোঁ স্রোতের মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তিনি প্রগতিশীল মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়ালেন, দেশের বিপদে ঘুরে দাঁড়ানোর ভাষাতেও কথা বললেন।
উদারনৈতিক অর্থনীতির অনুসারী ম্যাখোঁ জোর দিলেন মুক্তবাজার ও মুক্তসীমান্তের জরুরতের ওপরও। তিনি সহনশীলতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন, নাকচ করলেন বিভক্তিকে। ম্যাখোঁ একই সঙ্গে বহিরাগত আবার ঘরের লোক, তিনি প্রচলিত বাম-ডানের জবরজং দশা থেকে বের হয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিলেন; কিন্তু কোনো রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পথে নয় এবং তিনি ছাঁচটা ভেঙে দিলেন। ইউরোপের উদারনৈতিক পাল্টা-বিপ্লব শুরু হয়ে গেল এই রোববার। ম্যাখোঁর এই সফলতা অঙ্কিত হয়ে থাকবে ফ্রান্সের ফ্রন্ট ন্যাশনালের জাতিবিদ্বেষী ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জোরদার প্রত্যাখ্যান হিসেবে।
ম্যাখোঁ কীভাবে ট্রাম্পকে মোকাবিলা করবেন, তা হবে দেখার মতো এক পরীক্ষা। অবশ্য যে দুঃস্বপ্ন ইউরোপীয়দের জাগিয়ে রেখেছিল, ট্রাম্প এখনো ততটা ভয়ংকর হয়ে ওঠেননি। এ পর্যন্ত যা দেখা গেল, তাঁর ঘেউ ঘেউ তাঁর কামড়ের চেয়ে বেশি খারাপ।

দ্য নিউইয়র্কার
জন ক্যাসিডি
যে ইউরোপ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গত একটা দশক হারিয়ে ফেলেছে, মাত্র একটা নির্বাচন তা ফিরিয়ে দেবে না। একটা বিজয় দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন টিকিয়ে রাখা ও এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট জনপ্রিয় সমর্থন জোগাড় করাও কঠিন হবে। ম্যাখোঁ খোলা সীমান্ত, মুক্তবাজার ব্যবসা, শ্রমিকের অবাধ চলাচল এবং শরণার্থী ও মুসলমান সংখ্যালঘুদের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বৃহত্তর উদ্যোগের পক্ষে। এর সবকিছুই এখন হুমকির মুখে। ম্যাখোঁর উচ্চাভিলাষী চিন্তাধারা হলো এই—ফ্রান্স যদি গুরুতর অভ্যন্তরীণ সংস্কার চালাতে পারে, তাহলে জার্মানিকে রাজি করিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও ব্যয়সংকোচনের অর্থনৈতিক নীতি থেকে সরিয়ে প্রবৃদ্ধিমুখী পথে নিতে পারা যাবে। আগেকার ফরাসি প্রেসিডেন্টরাও এ ধরনের অভিলাষী যাত্রা শুরু করেছিলেন, কিন্তু কঠিন বাধার মুখে সবই বিফল হয়েছে। ম্যাখোঁ কি তাঁদের চেয়েও ভালো করবেন?

দ্য ওয়্যার
ফ্রান্স ও পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা
শিভালি লাওয়াল
ফ্রান্স সেই সব পশ্চিমা শক্তির অন্যতম, যারা সিরিয়ার চলমান যুদ্ধে বিপুলভাবে জড়িত। ম্যাখোঁ বাশার আল-আসাদের সরকার এবং ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে আগাগোড়াই তুমুল সরব। সুতরাং, নতুন প্রশাসনের শীর্ষ অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকবে নিরাপত্তা প্রশ্ন। তাই ফ্রান্সের মুসলিম নাগরিকদের খুশি রেখেই তাঁকে চতুরতার সঙ্গে বিষয়গুলো সামলাতে হবে।
রাশিয়া প্রশ্নে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে মস্কোর ওপর অবরোধ চাপানোর পক্ষে ম্যাখোঁ মত দিয়েছেন। তিনি রাশিয়াকে মিনস্ক চুক্তি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন এবং দেশটির পররাষ্ট্রনীতিকে আগ্রাসী বলে অভিহিত করেছেন। তবে সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হবে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর মোকাবিলা। ন্যাটো, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, মুসলিম ট্রাভেল ব্যান ও সংরক্ষণবাদ বিষয়ে দুজনের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে একেবারেই আলাদা।
অনুবাদ ও সংকলন : ফারুক ওয়াসিফ