বাংলাদেশে জাতিসংঘের মহাসচিব

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকা সফরে এসে খাঁটি কথাটি স্পষ্ট ও জোরালোভাবে প্রকাশ করলেন। কথাটি হলো, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে ও সংঘটিত অপরাধের বিচার হতে হবে। বাংলাদেশের উচিত হবে, দ্বিপক্ষীয় ফোরামে স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে সচেষ্ট থাকা। এবং একই সঙ্গে অপরাধীদের বিচার যাতে হয়, সে জন্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে বহুপক্ষীয় ফোরামে সব ধরনের কূটনৈতিক তৎপরতায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা।

আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রধানের সমন্বিত সফর নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের অবস্থানে সরাসরি প্রভাব না ফেললেও বিশ্বজনমত গঠনে বিরাট প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা এবং কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ৪৮ লাখ ডলারের অনুদান ঘোষণার জন্য বিশ্বব্যাংকের সাধুবাদ প্রাপ্য। তবে নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক আদালতের মতো স্বীকৃত বৈশ্বিক ফোরাম দ্বারা মিয়ানমারকে অব্যাহত চাপ দেওয়ার বিকল্প নেই। তাদের কঠোর নির্দেশনা বা আলটিমেটামের মুখোমুখি না হলে মিয়ানমারের সরকার তার অবস্থান বদলাবে না।

 আমরা জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ দিই যে তিনি সংকট সমাধানের মূল বিষয়টি ধরতে পেরেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, রোহিঙ্গারা যাতে আদি নিবাসে ফিরতে পারে, সে জন্য আগে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর সে জন্য মিয়ানমারকে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মিয়ানমার নানা ধরনের চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সম্পাদনে যতটা উৎসাহী, রাজনৈতিক সমাধানে ততটা আগ্রহী নয়।

রোহিঙ্গা বিতাড়নের যে রাষ্ট্রীয় নীতি তারা অনুসরণ করছে, সেখানে কোনো পরিবর্তনের আভাস নেই। তারা এ বিষয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা করছে বলেও জানা যায় না। কারণ, এটাই সত্য যে বিশ্ব নেতৃবৃন্ পর্যন্ত যে যেখানে যা–ই করেছেন, তাতে ‘অগ্রগতি’ আছে, কিন্তু যথেষ্ট কার্যকরতা নেই। প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের মহাসচিব সদুত্তর দিতে পারেননি যে কেন তাঁরা চুক্তি করতে গিয়ে রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করতে পারেননি। এটা জাতিসংঘের দুর্বলতা যে ক্ষুদ্র ও দুর্বল জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক আত্মপরিচয় তারা মিয়ানমারকে স্বীকার করাতে পারে না। যদিও মহাসচিব স্বীকার করেছেন যে তারা রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘের মহাসচিব স্বীকার করেছেন যে রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। এখন বাংলাদেশ কূটনীতির অন্যতম মুখ্য লক্ষ্য থাকবে, এই বিভক্তি কীভাবে ঘোচানো যায়, সেই লক্ষ্যে নানামুখী উদ্যোগ ও তৎপরতা জোরদার করা। এই সত্যটা বোঝানো দরকার যে নিরাপত্তা পরিষদ ঐক্যবদ্ধ না হলে মিয়ানমার তার রোহিঙ্গা নীতি বদলাবে না। আর সমতাপূর্ণ রোহিঙ্গা নীতি ঘোষণা করা ছাড়া প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল কোনো টেকসই পরিস্থিতি নিশ্চিত করা অসম্ভবই থেকে যাবে।

মিয়ানমারের ওয়েস্টার্ন কমান্ডের নির্দিষ্ট সাত সামরিক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডার যৌথ সিদ্ধান্ত একটি বড় অগ্রগতি। বিশ্বনেতাদের সম্মিলিতভাবে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বিশ্বসম্প্রদায়ের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়, এ কথা উল্লেখ করে জাতিসংঘ মহাসচিব কার্যত তাঁর নেতৃত্বাধীন সংগঠনের অসহায়ত্বই প্রকাশ করলেন। তবে এ কথাও সত্য যে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতিসংঘের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, তার সবটাই তারা মিয়ানমারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছে, তা প্রতীয়মান হয় না।

আমরা আশা করব, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মহাসচিবের আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ার বিষয়টি বিশ্ববিবেককে নতুন করে নাড়া দেবে। মানবতা ভুলে ভূরাজনৈতিক কৌশলে আচ্ছন্ন নিরাপত্তা পরিষদের ঘুম ভাঙাতে সহায়ক হবে।