বিআরটিএর ঘুম ভাঙবে কবে

সম্পাদকীয়

গত সোমবার রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডে শওকত আলী নামের এক বাইকচালক যে ক্ষোভে-দুঃখে নিজের মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছেন, সেটি সড়ক পরিবহন খাতের সীমাহীন নৈরাজ্য ও অনিয়মের একটি উদাহরণ মাত্র। ঘটনাটি মর্মান্তিক। বাইকচালক শওকত আলীর স্যানিটারি সামগ্রীর দোকান ছিল। করোনার কারণে সেই দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তিনি ৮০ হাজার টাকায় একটি মোটরসাইকেল কিনে রাইড শেয়ারিং বা যাত্রী পরিবহনের কাজ করতেন। কোনো কোম্পানির অ্যাপস ব্যবহার করে রাইড শেয়ারিং করলে ভাড়ার ২৫ শতাংশ তাদের দিতে হয়। শওকত আলী মনে করেন, এটি তাঁদের প্রতি জুলুম।

এ কারণে তিনি অ্যাপস ছাড়াই রাইড শেয়ারিং করে আসছিলেন। আরও অনেক বাইকচালক তা করেন এবং পদে পদে হয়রানির শিকার হন। কয়েক দিন আগে অ্যাপস না থাকায় শওকতের বিরুদ্ধে এক হাজার টাকার মামলা করে ট্রাফিক পুলিশ। সোমবার সকালে বাড্ডা লিংক রোডে এক পুলিশ সার্জেন্ট তাঁর গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে যান। তখন শওকত মামলা না দেওয়ার অনুরোধ জানালেও ট্রাফিক সার্জেন্ট কাগজপত্র নিয়ে যান। এরপর শওকত নিজের বাইকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানান।

বাড্ডা থানা-পুলিশ বলেছে, শওকত নিজের বাইকে আগুন দিয়ে অন্যায় করেছেন। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে যে সুযোগ পেলেই রাস্তায় গাড়ি আটকিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে যানবাহনের চালকদের কাছ থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে, তার বিহিত কী! এসব তো আরও বড় অন্যায়।

সড়ক পরিবহনের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, ‘সড়ক, যান, চালক—কিছুই ঠিক নেই।’ সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার সড়ক পরিবহন আইন করলেও সেটি কার্যকর করতে পারেনি পরিবহনমালিক ও শ্রমিক সংগঠনের বিরোধিতার মুখে। আইন করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। আবার সেই আইনের বিরুদ্ধে ধর্মঘটও পালন করেছেন সরকার–সমর্থিত মালিক ও শ্রমিক সংগঠন।

২০১৮ সালে দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩। গত দুই বছরে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও অবৈধ লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা আরও বেড়েছে। বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিভিন্ন শ্রেণির যানবাহনের জন্য চালক লাইসেন্স আছে প্রায় ২৮ লাখ। এগুলোর মধ্যে একই লাইসেন্সে একজন ব্যক্তি মোটরসাইকেল ও অন্য যানবাহন চালান। এঁদের বাদ দিলে চালকের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ। সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৮ লাখ। অর্থাৎ ১৮ লাখ যানবাহন ‘ভুয়া’ চালক দিয়ে চলছে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া লাইসেন্স ব্যবহার করলেও বেশির ভাগ করছেন বাধ্য হয়ে।

সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁরা সংস্থার অনিয়ম ও গাফিলতি না দেখে গরিব বাইকচালক ও অটোচালকের ওপর হামলে পড়েন। এতে সড়কে শৃঙ্খলা আসার বদলে একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে চলেছে। চালকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া কিংবা মামলার ভয় দেখিয়ে নগদ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। বিআরটিএতে একটি চক্র গড়ে উঠেছে, যারা লাইসেন্স দেওয়ার নাম করে চালকদের ঘোরায় এবং ফায়দা আদায় করে। সড়ক ও সেতুমন্ত্রী নিজেও বিআরটিএর দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। বিআরটিএর ঘুম ভাঙবে কবে?