বিআরটিসির বাস

বেসরকারি বাসমালিকদের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠলেও সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছে। বিআরটিসির প্রধান তিনটি প্রকল্প—বাস কেনা, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ। প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বিভিন্ন সময় স্বীকার করেছেন যে বিআরটিসিতে দুর্নীতি আছে। কিন্তু সেই দুর্নীতির লাগাম তিনি টেনে ধরতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা নেই।

মঙ্গলবার প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দায়্যু কোম্পানি থেকে ২৫৫টি বাস কেনা হয়েছিল। এসব বাসের মেয়াদ ধরা হয় ১৫ বছর। কিন্তু ১০ বছর না যেতেই বিআরটিসি ৫টি বাস লোহালক্কড় হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে। আরও ৩০টি বাস একইভাবে বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে ঋণ নিয়ে বাসগুলো কেনা হয়েছিল। করসহ প্রতিটি বাসের দাম পড়ে ধরনভেদে ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকা। ইডিসিএফের ঋণের শর্ত ছিল, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বাস কিনতে হবে।

উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাস কিনলে যে দর-কষাকষির সুযোগ থাকে, এ ক্ষেত্রে তা ছিল না। কেবল দক্ষিণ কোরিয়া নয়; চীন, ভারতসহ আরও যেসব দেশ পরিবহন খাতে ঋণ দিয়েছে, শর্ত হিসেবে তাদের বাসই কিনতে হয়েছে। ভারত ও চীন থেকে কেনা বাসও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অচল হয়ে পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ ঋণদাতা দেশ বেশি দামে তাদের নিম্নমানের বাসই গছিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশকে। বড় সমস্যা হলো বাস রক্ষণাবেক্ষণ করা যাঁদের দায়িত্ব, তাঁদের অবহেলা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বাসগুলো রাস্তায় নামার অযোগ্য হয়ে পড়ে। বাস ডিপোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বাসের নতুন যন্ত্রপাতি বিক্রি করে পুরোনো যন্ত্রপাতি লাগানো কিংবা আত্মসাৎ করার গুরুতর অভিযোগ আছে। বিআরটিসি দুই পদ্ধতিতে বাস পরিচালনা করে থাকে—নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ও ভাড়াপদ্ধতিতে। যেসব সংস্থা ভাড়ায় বিআরটিসির বাস রাস্তায় নামায়, তারা এর রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে অধিক ট্রিপ দিয়ে বেশি মুনাফা পেতে উদ্‌গ্রীব।

প্রথম আলোর তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে ১৫৩টি বাস লোহালক্কড় হিসেবে বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করেছে বিআরটিসি। দায়্যু কোম্পানির অচল বাসগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে দাম ধরা হয়েছে দুই থেকে তিন লাখ টাকা। ৮০ থেকে ৯০ লাখ টাকার বাস ১০ বছর না যেতেই যদি দুই লাখ টাকায় লোহালক্বড় হিসেবে বিক্রি করতে হয়, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এই জাতীয় অপচয়ের প্রতিকার কী? সরকারের নীতিনির্ধারকদের দাবি, বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে হাঁটছে। তাহলে কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিদেশ থেকে বাস কিনতে হচ্ছে কেন? স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কেন আমরা পরিবহন খাতকে স্বাবলম্বী করতে পারলাম না? অন্যান্য সংস্থার মতো বিআরটিসির সরকারি কর্মকর্তারা কেনাকাটায় যত উৎসাহী, পরিবহন খাতকে স্বাবলম্বী করতে ততটাই নিরুৎসাহী।

সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, দুদক তাঁর মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁদের সহায়তা করবেন। কিন্তু ২০১৮ সালে ওই সংস্থা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি বন্ধে যে ২১ দফা সুপারিশ করেছিল, গত তিন বছরেও তা কেন বাস্তবায়িত হলো না? দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে কেবল মুখে ফাঁকা আওয়াজ তুললে বিআরটিসি তথা মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি কখনো বন্ধ হবে না।