বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বন্ধ হোক

আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে দুর্গোৎসবে কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে ১৩ অক্টোবর হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির-পূজামণ্ডপে যে সন্ত্রাসী হামলা শুরু হয়েছিল, রোববার পর্যন্ত তা বন্ধ হয়নি। প্রথম দিকে মন্দির ও পূজামণ্ডপ লক্ষ্যবস্তু হলেও পরবর্তীকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরেও ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় ২০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের আগে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার সেই পুরোনো অপকৌশলই ব্যবহার করা হয়েছে।

দুর্বৃত্তরা একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে কীভাবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব কি ঘটনার পেছনে ছোটা কিংবা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা? সন্ত্রাসী হামলা বন্ধে তারা কী করেছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে যথার্থভাবেই। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত প্রশাসনের কাজকর্মে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান খান পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশাসন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। আক্রান্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারাসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষও একই অভিমত প্রকাশ করেছেন।

সরকারের কঠোর নিরাপত্তা ও অব্যাহত অভয়বাণী সন্ত্রাসী হামলা থেকে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে পারেনি। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতারা অঘটনের দায় নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছেন। দোষারোপের অপসংস্কৃতি পরিহার করে সরকারের উচিত সন্ত্রাসী যে–ই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু কে অপরাধী, কে অপরাধী নয়—তা চিহ্নিত করতে প্রয়োজন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত। বিভিন্ন গণমাধ্যমে যেসব খবর এসেছে, তাতে সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নাম এসেছে।

পীরগঞ্জের ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো, দুর্বৃত্তরা হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে নানা রকম অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্ত ব্যক্তি ধর্মীয় বিষয়ে ফেসবুকে আদৌ স্ট্যাটাস দিয়েছেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হয় না। ২০১২ সালে রামুতে যেমন কিংবা ২০১৬ সালে নাসিরনগরে যেমন ভুয়া স্ট্যাটাস দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল, এবারও পীরগঞ্জে তার পুনরাবৃত্তি ঘটল। এর বাইরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ফেসবুক, ইউটিউব চ্যানেল ইত্যাদিতে লাগাতার বিদ্বেষমূলক প্রচার পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে দিয়েছে। এসব মাধ্যমে কেবল ধর্মীয় বিষয়ে বিদ্বেষমূলক প্রচার চলছে না; এর সঙ্গে একশ্রেণির নেতাও এমন বক্তৃতা-বিবৃতি দেন, যা সম্প্রীতি ও সংহতির অন্তরায়। সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে হলে এসব প্রচারণা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

সরকার ইতিমধ্যে রংপুর ও ফেনীর পুলিশ সুপারসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করেছে। অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে যদি উল্লিখিত ব্যক্তিদের বদলি করা হয়ে থাকে, তাহলে প্রথম প্রত্যাহার করা উচিত কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে। তাঁদের দায়িত্বহীনতা ও অযোগ্যতার কারণেই কুমিল্লার ঘটনা এত দূর গড়াতে পেরেছে। কুমিল্লার অঘটনের পেছনে স্থানীয় রাজনীতির লাভ–ক্ষতির হিসাবও কাজ করেছে বলে গুরুতর অভিযোগ আছে। আমরা এ বিষয়ে আগাম মন্তব্য করতে চাই না। তবে মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার পেছনে কাদের ইন্ধন ছিল, তা বের করতে নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হতে হবে। এটা সময়ের দাবি।