বৃত্তাকার ওয়াটার বাস

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না।’ আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, শত বছর পর তাঁর এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করে চলেছে আমাদের সদাশয় সরকারের অনেক সংস্থা ও বিভাগ। তারা যত কাজ করে, কথা বলে তার চেয়ে বেশি। আড়ম্বর করে আরও বেশি।

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বুড়িগঙ্গার ওপর চক্রাকার নৌযান চলাচল চালু করা হয়েছিল ২০০৪ সালে। ইতিমধ্যে প্রকল্পটি এক অর্থে অক্কা পেয়েছে। ১২টি ওয়াটার বাসের ১১টি অব্যবহৃত অবস্থায় আছে, একটি চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ থেকে যাত্রী আনা-নেওয়া করছে। অথচ প্রকল্প চালুর সময় অভয়বাণী শোনানো হয়েছিল, ঢাকা শহরের যানজট কমাতে এ চক্রাকার নৌযান সহায়ক হবে, মানুষ স্বল্প সময়ে ও সাশ্রয়ী ভাড়ায় গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু ওয়াটার বাস প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ ক্রমাগত লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে জনগণের করের ১০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বিনিময়ে যা পেয়েছে, তা খুবই সামান্য। ২০১৮-২০১৯ সালে গাবতলী রুটে আয় ৮ লাখ টাকা, ব্যয় ৪১ লাখ টাকা। এটি ব্যর্থতা ও অদক্ষতার অনবদ্য নজির।

১৯ জুন প্রথম আলোয় ‘অঙ্কুরেই শেষ ওয়াটার বাস’ শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, তাতে কেবল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ নয়, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতা ও অবিমৃশ্যতা প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকার চারদিকে পাঁচটি নদ-নদী যথাক্রমে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যায় ওয়াটার বাস চালুর পরিকল্পনা ছিল। প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে গাবতলী-সদরঘাট ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ওয়াটার বাস চালু করা হয়।

ওয়াটার বাস প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ার প্রথম ও প্রধান কারণ নদীদূষণ ও নাব্যতা হ্রাস। বুড়িগঙ্গার তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষাকাল ছাড়া বাকি সময়টা যাত্রীদের নাকে রুমাল চেপে ওয়াটার বাসে বসতে হতো। ঢাকা শহরের যত ময়লা–আবর্জনা ও বর্জ্য, তা গিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ে। দ্বিতীয় কারণ ওয়াটার বাসের ১২টি ঘাট বা ল্যান্ডিং স্টেশন করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। এসব ঘাট এমন স্থানে অবস্থিত, যেখান থেকে নেমে যাত্রীদের শহরে যেতে ভোগান্তিতে পড়তে হতো। অনেক ঘাটের সঙ্গে শহরের সংযোগ সড়কই নেই। ফলে যাত্রীরা স্থলপথে যানজটের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ওয়াটার বাসে উঠতেন না। তৃতীয় কারণ স্বার্থান্বেষী মহলের বিরোধিতা। তারা একাধিকবার ওয়াটার বাস চলাচলে বাধাও দিয়েছে। এ অবৈধ কার্যক্রমে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতার ইন্ধন থাকার অভিযোগ আছে, যিনি সড়ক-নৌপথ দুটোই নিয়ন্ত্রণ করেন।

বিআইডব্লিউটিএ ফের বুড়িগঙ্গায় চক্রাকার ওয়াটার বাস চালু করতে আগ্রহী। কিন্তু তার আগে নদী দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কেবল ওয়াটার বাস চলাচলের জন্য নয়, দেড় কোটি জন–অধ্যুষিত ঢাকা শহরকে বাঁচানোর জন্যও নদী দূষণমুক্ত রাখা প্রয়োজন। একে অপরের ওপর দায় চাপানোর সংস্কৃতি পরিহার করে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে একসঙ্গে বসে সমস্যাগুলো সমাধান করুক, ওয়াটার বাস ফের চালু হোক, সেটাই প্রত্যাশিত।