মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান

সম্পাদকীয়

তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির শাসন চালু থাকা সত্ত্বেও আমাদের স্থানীয় সরকার কাঠামোটি রয়ে গেছে রাষ্ট্রপতির শাসনপদ্ধতির আদলেই। এখানে সংস্থাপ্রধানের হাতেই সমুদয় ক্ষমতা ন্যস্ত। অন্যদের কার্যত কোনো ক্ষমতা নেই। গত বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে বাংলাদেশ উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশন যেসব অভিযোগ করেছে, তা ভিত্তিহীন নয়। অন্যান্য স্থানীয় সরকার সংস্থার মতো আমাদের উপজেলা পরিষদ কাঠামোটি দুর্বল ও ভারসাম্যহীন। পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান (একজন অবশ্যই নারী হবেন) জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত। মেয়র (পৌরসভাভুক্ত এলাকা হলে) ও ইউপি চেয়ারম্যানরা পদাধিকারবলে সদস্য। বাস্তবে চেয়ারম্যানের ইচ্ছায়ই পরিষদ পরিচালিত হয়।

মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, নির্বাচিত প্রতিনিধি হয়েও তাঁরা বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। পরিষদের মাসিক সভায় তাঁদের ডাকা হয় না; ডাকলেও তাঁদের কথা আমলে নেওয়া হয় না। উপজেলার জনগণের সেবার জন্য পরিষদ গঠিত হলেও তাদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। আগে উপজেলার অবহেলিত নারীদের আয়বর্ধক উন্নয়ন প্রকল্পের সভাপতি ছিলেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি করে সেই ক্ষমতাটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

এতে প্রমাণিত হলো সরকার মুখে যতই জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতায়নের কথা বলুক না কেন, স্থানীয় সরকার সংস্থাকে কার্যত আমলানির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানরা অনেক আন্দোলনও করেছেন। আজ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানরা একই অভিযোগ এনেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে।

মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের পক্ষ থেকে আট দফা দাবি পেশ করা হয়েছে, যার মধ্যে আছে মহিলা অধিদপ্তরের উপজেলা পর্যায়ে সব উন্নয়ন কার্যক্রমে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের সম্পৃক্ত করা; গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের লক্ষ্যে নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও উপজেলা পর্যায়ে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া; প্রান্তিক জনগণ ও প্রশাসন পর্যায়ে নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা; প্রতিটি উপজেলায় মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের উন্নয়ন কার্যক্রম তদারকির জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার সংরক্ষিত আসনের মহিলা সাংসদকে দায়িত্ব দেওয়া; ঘোষিত নারী উন্নয়ন ফোরামের ৩ শতাংশ বরাদ্দ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে কার্যকর করা।

তাঁদের এসব দাবি অযৌক্তিক নয়। সরকার উপজেলা পরিষদে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ দৃষ্টি করেছে নিশ্চয়ই তাঁদের অলস বসিয়ে রাখার জন্য নয়। উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন কার্যক্রমে কেন তঁাদের সম্পৃক্ত করা হবে না? চেয়ারম্যানের মতো ভাইস চেয়ারম্যানরাও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা পান। সার্বিকভাবে উপজেলা পরিষদে যে ভারসাম্যহীন অবস্থা চলছে, তা দূর করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সরকারকে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে, যাতে চেয়ারম্যান বনাম ভাইস চেয়ারম্যান কিংবা চেয়ারম্যান বনাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে সংঘাত না হয়। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া হোক।

ভারতসহ অনেক দেশেই স্থানীয় সরকার সংস্থার সংস্কার হয়েছে এবং জনগণ এর সুফলও পাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও আমরা পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে আছি; কেন্দ্রীয় সরকার কোনোভাবে মুঠো আলগা করতে চাইছে না। তারপরও যেটুকু ক্ষমতা স্থানীয় সরকারকে দেওয়া হয়েছে, তা সংস্থার প্রধানই ভোগ করেন। তাই উপজেলা পরিষদসহ সব স্থানীয় সরকার সংস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।