যাবজ্জীবন সাজার ব্যাখ্যা

সম্পাদকীয়

যাবজ্জীবন সাজার অর্থ কী হবে, তা নিয়ে উচ্চ আদালতের আঙিনায় দীর্ঘকাল নানা আইনি প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে। এবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন সাজার মেয়াদসংক্রান্ত অস্পষ্টতা দূর হলো। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই রায়ের সুষম কার্যকারিতা নিশ্চিত করাই মূল চ্যালেঞ্জ। প্রতীয়মান হয় যে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে অবস্থানরত যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পাঁচ হাজারের বেশি কয়েদির কারাজীবনে সরাসরি এই ব্যাখ্যার প্রভাব পড়বে। তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, সব থেকে বড় প্রভাব প্রত্যাশিত মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে। ধীরে ধীরে হলেও এর হার কমে যেতে পারে।

আপিল বিভাগের সর্বশেষ ব্যাখ্যা প্রকারান্তরে দেশে একটি বিশেষ ধরনের সাজা প্রবর্তন করল। সেটা হলো মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মাঝামাঝি ‘আমৃত্যু কারাদণ্ড’ নামের সাজা। অবশ্য বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিল যে সেন্টেন্সিং গাইডলাইন নামে একটি বিষয় বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অনুসরণ করা হয়। এ ধরনের গাইডলাইনের অধীনে এ রকম অনেক দণ্ডাদেশ রয়েছে, যে বিষয়ে অস্পষ্টতা বা দ্ব্যর্থকতা পরিষ্কার করার বিষয় রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নিজেরও এ বিষয়ে একটা আগ্রহ আছে, যা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি যৌক্তিক পরিণতি লাভের আবশ্যকতা রয়েছে। যাবজ্জীবন নিয়ে আপিল বিভাগের রিভিউর রায়টি সেই প্রয়োজনের ওপর নতুন করে আলো ফেলেছে।

আলোচ্য মামলায় এর আগে আপিল বিভাগ তাঁর রায়ে বলেছিলেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ৩০ বছর, এই ধারণা সঠিক নয়। মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করলে এবং আদালত আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দিলে সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ ক ধারার অধীনে কোনো সুবিধা (বিচারাধীন কয়েদি থাকাকালে সাজার মেয়াদ থেকে বাদ যাবে) পাবে না।

এখন ৭ সদস্যের আপিল বিভাগের রিভিউর রায়ে নির্দিষ্ট হলো যে ‘যাবজ্জীবন’ কারাদণ্ডের মেয়াদ ৩০ বছর হিসেবে গণ্য হবে। এবং দণ্ডিত ব্যক্তি উল্লিখিত ৩৫ ক ধারার অধীনে সাজা কর্তনের সুবিধা পাবেন। তবে বিচারিক আদালত/ট্রাইব্যুনালও ‘আমৃত্যু কারাদণ্ড’ দিতে পারবেন। এটা লক্ষণীয় যে ‘আমৃত্যু কারাদণ্ডের’ ক্ষেত্রে জেল কোড অনুযায়ী সাজার মেয়াদ কর্তনের সুবিধা পেতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেননি।

আপিল বিভাগ তঁার রায়ের একটি সংক্ষিপ্ত আদেশ লিখিত আকারে প্রকাশ করেছেন। এর সারকথা হলো, প্রাথমিক অর্থে (প্রাইমাফেসি) যাবজ্জীবন কারাবাস সাজাপ্রাপ্ত মানে কোনো দণ্ডিতের বাকি জীবনের সবটাই কারাগারে কাটাতে হবে। কিন্তু দণ্ডবিধি এবং ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট বিধানাবলি একত্রে পাঠ করলে মনে হবে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে ৩০ বছরের কারাবাস। তবে যে ক্ষেত্রে আদালত বা যেকোনো ট্রাইব্যুনাল (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ) তাঁর রায়ে নির্দিষ্টভাবে বলে দেবেন যে অভিযুক্তকে অবশিষ্ট জীবন কারাগারেই কাটাতে হবে, সে ক্ষেত্রে উল্লিখিত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫ ক-এর অধীনে কোনো রেয়াত পাবেন না।

ফৌজদারি কার্যবিধি ও দণ্ডবিধির এ-সংক্রান্ত বিধানগুলো একসঙ্গে পড়লে যাবজ্জীবন মানে ৩০ বছরের কারাবাস। তবে আদালত, ট্রাইব্যুনাল, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক কাউকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হলে সেই দণ্ডিত ব্যক্তি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫-এ ধারার সুবিধা পাবেন না।

আমরা অবশ্য জানতে পেরেছি যে সাত সদস্যের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্যে আইনের ব্যাখ্যার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য মত-দ্বিমত ঘটেনি। সাতজনের মধ্যে সংখ্যালঘুর রায়দানকারী একমাত্র বিচারপতি শুধু এই মর্মে ভিন্নমত দিয়েছেন যে তিনি মনে করেন, সব ক্ষেত্রেই দণ্ডিত ব্যক্তি ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৫-এ ধারার অধীনে সাজার মেয়াদ কর্তনের সুবিধা পাবেন। অর্থাৎ আদালত যাঁর ক্ষেত্রে আমৃত্যু কারাদণ্ড নির্দিষ্ট করে রায় দেবেন, তিনিও বিচারাধীন থাকাকালে বন্দিজীবনের মেয়াদ কর্তনের সুবিধা পাবেন।

আমরা আশা করব, আপিল বিভাগের রায় অল্প সময়ের মধ্যে কার্যকর করে একটি উত্তম নজির স্থাপন করা হবে।