রেলের ব্যবসা-বাণিজ্য

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশ রেলওয়ে নিয়ে প্রথম আলোয় তিন পর্বে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রীয় এ যোগাযোগমাধ্যমের করুণ চিত্রই উঠে এসেছে। গত ১১ বছরে রেলের উন্নয়নে সরকার ৭৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরও লোকসান কমাতে পারেনি। গত অর্থবছরে রেলের পরিচালন লোকসান (অপারেটিং লস) হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলওয়ে লাভজনক না হওয়ার কারণ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কেনাকাটায় দুর্নীতি, অপরিকল্পিত প্রকল্প গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতি।

এ অবস্থার উত্তরণে রেলওয়ের উচিত ছিল দুর্নীতি কমানো এবং যাত্রী ও পণ্যসেবা বাড়িয়ে আয় বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হওয়া। রেললাইন সম্প্রসারণ করে অধিকসংখ্যক যাত্রী পরিবহনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা সেদিকে নজর না দিয়ে জমি ভাড়া দিয়ে রেলওয়েকে স্বাবলম্বী করার দিবাস্বপ্ন দেখছেন। রেলওয়ের অনুমোদন পাওয়া ও অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে ১৩টিই অপ্রধান কাজের শ্রেণিভুক্ত, যার মধ্যে আছে পাঁচতারা হোটেল, হাসপাতাল ও শপিং মল নির্মাণ।

রেলের প্রধান কাজ হলো যাত্রী ও পণ্যসেবা বাড়ানো। এ লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে মাত্র দুটি প্রকল্প—ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার রেলপথ ও গাজীপুরের ধীরাশ্রমে একটি অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিডি) নির্মাণ। ২০১৮ সালে ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন ঘিরে ‘মাল্টিমোডাল হাব’ বা বহুমাত্রিক যোগাযোগকেন্দ্র নির্মাণে প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় স্টেশন ঘিরে হোটেল ও বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স নির্মাণ করার কথা রয়েছে। রেলওয়ের যাত্রীসেবা ও অবকাঠামো উন্নয়নে গৃহীত যেকোনো প্রকল্পকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু জমি ভাড়া দিয়ে তারা খুব বেশি আয় করতে পারবে বলে মনে হয় না। রেলের জমির প্রতি অনেকেরই লোভ আছে। ঢাকা, চট্টগ্রামের মতো বড় বড় শহরের প্রাণকেন্দ্রে রেলওয়ের যেসব জমি আছে, তার সর্বোচ্চ ব্যবহার কীভাবে হবে, তা সমীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। কিন্তু প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, রেলওয়ে এসব উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে কোনো সমীক্ষা ছাড়াই। প্রকল্পের নামে কোনো উদ্যোক্তার উদ্দেশ্য যদি হয় জমি হাতিয়ে নেওয়া, তখন কী হবে?

রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম বলেছেন, তঁাদের উন্নয়ন প্রকল্পের ৭০ শতাংশ নিজস্ব উদ্যোগে এবং বাকি ৩০ শতাংশ পিপিপি বা সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে। রেলওয়ে নিজস্ব বাজেট থেকে এই অপ্রধান খাতে ব্যয় করলে যাত্রীসেবা ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় আরও কমে যাবে। লোকসানের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। পিপিপির মাধ্যমে যে আয় আসবে, তা মোট বাজেটের সামান্য অংশ মাত্র। তদুপরি এসব প্রকল্পকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী মহল তৎপর হয়ে ওঠে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ব্যবসা নয়, রেলের জমি।

যে রেলওয়ে নিজস্ব হাসপাতালই চালাতে পারে না, সেই প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল বা হোটেল ব্যবসা করে মুনাফা করবে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। গরিবের ঘোড়ারোগের মতো রেলওয়েরও ব্যবসা রোগে পেয়ে বসেছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে মনে রাখতে হবে, পিপিপি বা অপ্রধান প্রকল্পের মাধ্যমে রেলওয়ের যে আয় বাড়বে, তার চেয়ে অনেক বেশি আয় বাড়বে যাত্রী ও পণ্যসেবার মান বাড়াতে পারলে। পৃথিবীর যেসব দেশের রেলওয়ে স্বাবলম্বী, সেসব দেশে তারা যাত্রী ও পণ্যসেবা বাড়িয়েই তা করেছে। তারা পারলে আমরা কেন পারব না?