রোজিনার জামিন

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করা দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ও ৫ ধারায় মামলায় জামিন পেয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহ পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকা ও পাসপোর্ট জমা দেওয়ার শর্তে এ জামিন দেন। রোজিনা ইসলামের জামিন পাওয়ার বিষয়টি স্বস্তিদায়ক, আমরা একে স্বাগত জানাই।

জামিনের আদেশ প্রদানকালে আদালত বলেছেন, গণমাধ্যম গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ এবং গণমাধ্যমের কারণেই অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দায়িত্বশীল আচরণ করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মাননীয় আদালতের এ মন্তব্য সব ধরনের সংবাদমাধ্যমের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।

পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ১৭ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে হেনস্তা ও নির্যাতন করা হয়। ওই দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে তাঁকে শাহবাগ থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাত পৌনে ১২টার দিকে তাঁর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। শত বছরের পুরোনো যে আইনে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তা সাংবাদিকের বেলায় প্রযোজ্য বলে আমরা মনে করি না। ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা শত্রুদেশে গুপ্তচরবৃত্তি রোধে এ আইন করেছিলেন। আর রোজিনা গিয়েছিলেন তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, যা সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্বের অপরিহার্য অংশ। বাংলাদেশে এর আগে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়নি।

সাম্প্রতিক কালে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন, যার মধ্যে আলোচিত একটি নিয়োগ দুর্নীতিসংক্রান্ত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘এখন ১ কোটি দেব, পরে আরও পাবেন।’ এসব বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় দেশ ও জনগণ যেমন উপকৃত হয়েছে, তেমনি দুর্নীতিবাজদের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। এ ধরনের প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ক্ষুব্ধ করবে, এটাই স্বাভাবিক। রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ের একটি কক্ষে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে যে নিগ্রহ করা হয়েছে, তা নজিরবিহীন। সভ্য কোনো দেশে সাংবাদিকের সঙ্গে এমন আচরণ হতে পারে, তা অকল্পনীয়। রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যা ঘটছে, তা স্পষ্টতই আক্রোশ থেকে ঘটেছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের স্বার্থে আঘাত লাগায় তঁারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন।

এ আঘাত কেবল রোজিনা ইসলাম কিংবা প্রথম আলোর ওপর হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এ আঘাত স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপরও। তাই আমরা দেখেছি, জাতীয় প্রেসক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ গোটা সাংবাদিক সমাজ রোজিনার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। তাঁর সহকর্মী ও সহযোদ্ধারা শুরু থেকেই প্রতিবাদমুখর রয়েছেন। কেবল ঢাকা নয়, সারা দেশের সাংবাদিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন রোজিনার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে। সাংবাদিকদের এ ন্যায় সংগ্রামে এগিয়ে এসেছে নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমসংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান এবং জাতিসংঘও এ ঘটনায় প্রতিবাদ উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে। সব মহলের এ সমর্থন ও সহযোগিতা আমাদের যেমন সাহস জুগিয়েছে, তেমনি আমরা মনে করি, এটা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

রোজিনা ইসলামের জামিন হয়েছে, তা নিশ্চয়ই ইতিবাচক। কিন্তু কেবল জামিন নয়, আমাদের দাবি, এ মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি খড়্গ হিসেবে বিবেচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সাংবাদিকের কণ্ঠরোধকারী সব আইন বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে রোজিনার ওপর যাঁরা নির্যাতন চালিয়েছেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থেই তঁাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজেদের অপরাধ ঢাকতে রোজিনা ইসলামের নামে যেসব অপপ্রচার চালাচ্ছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করার দাবি জানাই।