লোকদেখানো নয়, কঠোর ব্যবস্থা নিন

সম্পাদকীয়

গত শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযান চলার পর থেকে এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক নিবন্ধনহীন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করার খবর আমাদের খুব আশ্বস্ত করে না। কেননা, অবৈধ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এটাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রথম অভিযান নয়।

অতীতেও বহুবার অভিযান চালানো হয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। যদিও তাতে স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি, বন্ধ হয়নি চিকিৎসাপ্রার্থীদের প্রতারিত হওয়া।

স্বাস্থ্য বিভাগের বরাতে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অভিযানের প্রথম তিন দিনে আট বিভাগে মোট ১ হাজার ১৪৯টি বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংক বন্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ২৮৬টি, চট্টগ্রামে ১৯০, রাজশাহীতে ১৩৫, রংপুরে ১৪, ময়মনসিংহে ১২১, বরিশালে ৬৫ ও সিলেট বিভাগে ৩৫টি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম ব্যবহার, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার দায়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হয়েছে। যারা চিকিৎসার নামে প্রতিদিন রোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে, ন্যূনতম আর্থিক জরিমানা তাদের শুভবুদ্ধি ফিরিয়ে আনবে বলে মনে হয় না।

তবে স্বীকার করতে হবে যে এবারের অভিযান পুরোপুরি নিষ্ফল হয়নি। অভিযানের কারণে অনেক অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও রোগনির্ণয় কেন্দ্রের মালিকেরা ভয় পেয়েছেন। অভিযান হতে পারে—এই শঙ্কায় নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলে পদ্মা জেনারেল হাসপাতাল নামের একটি ক্লিনিকের কর্মীরা গত রোববার সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের মাকে অস্ত্রোপচারের টেবিলে রেখে বাইরে তালা দিয়ে পালিয়ে যান। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মা ও সন্তানকে মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। মা ও নবজাতক ভালো আছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। আনাড়ি স্বাস্থ্যকর্মীরাই মায়ের অস্ত্রোপচার করেছেন। কী ভয়ংকর কথা!

কেবল ওই হাসপাতাল নয়, অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া অস্ত্রোপচার, ভুয়া চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র প্রদান, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরবরাহ, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার খবর অহরহ গণমাধ্যমে এলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ খুব বেশি নয়। মাঝেমধ্যে অনিবন্ধিত হাসপাতাল, ক্লিনিক বন্ধ করেও চিকিৎসাক্ষেত্রের ভয়াবহ দুর্নীতি ও প্রতারণা বন্ধ করা যাবে না। বন্ধ হয়ে যাওয়া চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে নতুন করে ব্যবসা খুলে বসেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল, ৭২ ঘণ্টা অভিযান চলবে। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয়, এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। সময়ে সময়ে অবৈধ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান হয়তো কিছুটা কাজে দেবে।

কিন্তু এতে টেকসই করতে যা প্রয়োজন, তা হলো এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়মিত কঠোর নজরদারি ও তদারকি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য খাতে যে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও দুর্নীতি চলছে, টোটকা ওষুধ দিয়ে তা দূর করা যাবে না।

স্বাস্থ্য খাতে অনেক ‘সাহেদ করিম’ আছেন, তাই একজন বা দুজনকে ধরে জেলে পাঠালে কিংবা মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়ন করা যাবে না। যাঁরা স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চলতেই থাকবে।