শহরমুখী জনস্রোত

গত রোববার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত সেমিনারে বাংলাদেশের নগরায়ণের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা খুবই হতাশাজনক। সেমিনারে উত্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশ শহরে বাস করে। ২০১১ সালে এই হার ছিল ২৮ শতাংশ। এই হারে শহরে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ মোট জনসংখ্যার ৫৮ শতাংশই শহরে বাস করবে।

পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দ্রুতগতিতে নগরায়ণ হচ্ছে। শহরমুখী জনস্রোতের প্রধান কারণ বেকারত্ব। কৃষি ছাড়া গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। এ কারণে গ্রামের মানুষ শহরে এসে ভিড় জমাচ্ছে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন ইত্যাদি কারণেও মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। কিন্তু তাদের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য শহরের আছে কি না, সে বিষয়টি বরাবর উপেক্ষিতই থেকে গেছে। আমাদের
নগর-পরিকল্পনায়ও তেলা মাথায় তেল দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। একই কারণে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপের মতো একটি ভালো উদ্যোগ বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সংশোধনীর নামে স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থরক্ষা হচ্ছে।

জনসংখ্যার অনুপাতে একটি শহরে কী পরিমাণ আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক ভবন, দাপ্তরিক ভবন, রাস্তাঘাট, জলাশয় ও খেলার মাঠ থাকবে, তা আগে থেকেই ঠিক করা হয়। সেভাবে নগরের অবকাঠামো তৈরি করা হয়। পাকিস্তান আমলে ঢাকার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার পরও বিভিন্ন সরকারের আমলে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব পরিকল্পনা কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে বহুল আলোচিত আদর্শ শহর-উপশহর কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।

বিআইপির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট শহুরে মানুষের ৩২ শতাংশ একটি শহর, অর্থাৎ কেবল ঢাকা শহরে বাস করে। এটি কেবল অস্বাভাবিক নয়, অসুস্থ নগরায়ণ ও অসম উন্নয়ন পরিকল্পনার ফল। সেমিনারে নগরবিদেরা যথার্থই বলেছেন, নানা সময়ে বিভিন্ন নগর এলাকার মহাপরিকল্পনা নেওয়া হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। কেন হয়নি, সে প্রশ্নের উত্তর সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও জানা আছে বলে মনে হয় না। স্থানীয় সরকারবিষয়ক মন্ত্রী তাজুল ইসলামও স্বীকার করেছেন, নগরায়ণের পরিকল্পনা খণ্ড খণ্ডভাবে হচ্ছে। তিনি শহরে জনস্রোত ঠেকাতে গ্রামেও শহরের সুবিধা দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর এই বক্তব্য অনেকটা ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ দেওয়ার মতো। শহরেই তো তাঁরা ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা দিতে পারছেন না, গ্রামে শহরের সুবিধা দেবেন কীভাবে? কেবল গালভরা বক্তৃতা ও উন্নয়নের রঙিন খোয়াব দেখালেই পরিকল্পিত নগরায়ণ হবে না।

বাংলাদেশের নগরায়ণে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেখানে ঢাকা শহরে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ছে, সেখানে অনেক বিভাগীয় শহরেও লোকসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ঢাকামুখী এই জনস্রোতের কারণ প্রশাসনিক ও আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামোর এককেন্দ্রিকতা। সরকার মুখে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বললেও বাস্তবে তার উল্টোই ঘটছে। সুষ্ঠু ও সুস্থ নগরায়ণের জন্য কেন্দ্রমুখিতা পরিহার করতে হবে।

পরিকল্পিত শহর মানে সেখানকার সব বাসিন্দার আবাসিক ব্যবস্থাসহ সব সুবিধা নিশ্চিত করা। কিন্তু সরকারের নগর-পরিকল্পনায় শহরে বসবাসকারী দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষগুলো বরাবরই বাইরে থেকে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ কেবল নাগরিক দুর্ভোগ বাড়ায় না, উন্নয়নের গতিও মন্থর করে। জনস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আশা করি, সরকার বিআইপির প্রস্তাবগুলো আমলে নিয়ে ‘অবাসযোগ্য শহরের’ বদনাম ঘোচাতে টেকসই ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না।