শাহ আবদুল করিমের জমি

বাংলাদেশের হাজারো গ্রামের মতো সাধারণ এক গ্রাম উজানধল, পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কালনী। উজানধলের নাম হয়তো আমাদের অজানাই থেকে যেত, যদি না এই গ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকত শাহ আবদুল করিমের নাম। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এ গ্রামেই ১৯১৬ সালে জন্মেছিলেন এই গৃহী বাউল। এখানেই কেটেছে তাঁর ছেলেবেলা, এখানেই পরের বাড়িতে রাখালি করেছেন। এখানেই পালন করেছেন সংসারধর্ম। ২০০৯ সালে মৃত্যুর পর এ গ্রামেই হয়েছে তাঁর কবর। বসতভিটার সামান্য জায়গাটুকু ছাড়া চাষাবাদ বা আয়-রোজগারের জন্য এ উজানধলে বাউল করিমের নিজস্ব কোনো জমি ছিল না। শুধু উজানধলই–বা বলি কেন, কোথাও বাড়তি কোনো জমি তাঁর ছিল না।

কিংবা কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্য বলা হলো না, কাগজে-কলমে রীতিমতো ২ একর ১১ শতক জমির মালিক ছিলেন শাহ আবদুল করিম। ১৯৬৪ সালে ভূমিহীন কোটায় জালালপুরে বাউল কবিকে স্থায়ীভাবে এ জায়গাটুকু বন্দোবস্ত দিয়েছিল সরকার। তাঁর নামে জমি রেকর্ডও হয়েছে। খাজনাও দিয়েছেন নিয়মিত। বন্দোবস্তের কাগজপত্র, খাজনার রসিদ—সবই আছে, খালি দখলটা পাননি। যখনই দখল নিতে গেছেন, বাধা দিয়েছে তাড়ল গ্রামের প্রভাবশালী খলিল চৌধুরীর পরিবার। দখল না পাওয়ার দুঃখ একটি গানেও বলে গেছেন শাহ আবদুল করিম, ‘কাগজপত্রে বন্দোবস্ত পেয়েছে তো বটে/ আজও বেদখল আছে জোতদারের দাপটে/ সময় গেল টাকাপয়সা গেল যে বিস্তর/ আশাতে আছে প্রায় একত্রিশ বৎসর/ শক্তি সম্পদ না থাকাতে সবুর করে আছে/ ভুলিতে পারিবে কি যত দিন বাঁচে।’ তারপর আরও এক যুগ বেঁচেছিলেন শাহ আবদুল করিম, দখল পাননি।

অথচ এ জমি তাঁকে কোনো ব্যক্তি দেননি, দিয়েছে সরকার, তারপরও ৫৭ বছরে তাঁকে বা তাঁর উত্তরাধিকারী একমাত্র ছেলে শাহ নূর জালালকে সেই জমির দখল বুঝিয়ে দিতে পারেনি প্রশাসন। এখানে এসে মনে হয়, তাহলে সত্যিই ‘জনগণ’ সকল ক্ষমতার মালিক, প্রশাসন তার কাছে অসহায়। তবে সেই ‘জনগণ’কে হবে হবে প্রভাবশালী। আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত যাঁর গানের ভক্ত, ১৯৯৫ সালে দিরাইয়ে এক জনসভায় যাঁকে লক্ষ করে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমার বাবা যাঁর গানের ভক্ত, আমি তাঁকে উপযুক্ত সম্মান দেব’, সেই শাহ আবদুল করিমও ‘শক্তি সম্পদ না থাকাতে’ এই প্রভাবশালীদের কাছে কত অসহায়! একুশে পদক পাওয়া জাতীয় একজন শিল্পীরই যদি এ দশা, তাহলে আমজনতার অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।