শিক্ষার মানের ক্রমাবনতি

সম্পাদকীয়

যখন দেশের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ উদ্‌যাপন করছে, তখন সরকারি খাতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার মানের ক্রমাবনতির খবর আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। শিক্ষার মান নিয়ে বহু বছর ধরেই আলোচনা-সমালোচনা হয়ে আসছে। স্বাধীনতার পর প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের তোড়জোড় চলেছে। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নে কাউকে কার্যকর ও টেকসই কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

সরকারের নীতিনির্ধারক ও শিক্ষার অভিভাবকেরাও শিক্ষার দুরবস্থার কথা জানেন; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেন না। তাঁরা হয়তো ভাবেন, উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে থাকলেই ঝড় ঠেকানো যাবে। সেই ভুল ভাবনার পরিণতি যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা আবার আমরা শুনলাম অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিউদ্দিন মাহমুদের কণ্ঠে। তিনি কেবল অর্থনীতিবিদ নন, একজন শিক্ষাবিদও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সেমিনারে অধ্যাপক মাহমুদ বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সংকট মানহীন শিক্ষা। গত ৩০ বছরে আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলেছি। বিশেষত, মাধ্যমিক শিক্ষায় সংকট বেশি। এখন থেকে এর পুনরুদ্ধারকাজ শুরু করা হলেও ঠিক করতে আরও ৩০ বছর লাগবে।

তাঁর কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। বেহাল শিক্ষার কথা বলতে গিয়ে তিনি যে ৩০ বছরের উল্লেখ করেছেন, সেটা স্বৈরাচারের পতন–পরবর্তী কথিত গণতান্ত্রিক শাসনামল। এই সময়ে শিক্ষার অবনতি ঘটে থাকলে তার দায় পূর্বাপর সব সরকারকেই নিতে হবে। তাঁর বক্তব্যের প্রতিফলন দেখতে পাই যুক্তরাজ্যভিত্তিক কিউএসের র‍্যাঙ্কিংয়েও। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অবস্থান যথাক্রমে ১৪২ ও ২০২তম। তিন বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় দুটির অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১২৭ ও ১৭৫তম। একই সময়ে বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের উন্নতি ঘটছে বলে কিউএসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। এর জন্য জরুরি হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষক, যুগোপযোগী ও যথাযথ শিক্ষাক্রম এবং নিরন্তর গবেষণা। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেই গবেষণাই অবহেলিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় মাত্রাছাড়া অনিয়ম ও দুর্নীতি, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, দলীয়করণ, নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও যোগ্যতার বদলে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো বিষয়গুলো পরিস্থিতিকে শোচনীয় করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে কী করে?

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মাধ্যমিক শিক্ষার মারাত্মক অবনতির কথা বলেছেন। দেরিতে হলেও আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ২০২৩ সাল থেকে নতুন পাঠক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই বাস্তবতায় আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সরকার শিক্ষার মানের এই শোচনীয় দশা দূর করতে দ্রুত প্রয়োজনীয় ও সমন্বিত উদ্যোগ নেবে। শিক্ষাকে সংখ্যা হিসেবে না দেখে মানোন্নয়নের দিকে সংশ্লিষ্টদের অধিক মনোযোগী হতে হবে। সব ধরনের দলীয় ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে শিক্ষাকে স্থান দিতে হবে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি দিতে হবে। দেশে কত বেশি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে কি না, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন কি না, সেই দিকে নজরদারি রাখা। যেকোনো মূল্যে শিক্ষার মানের অবনমন ঠেকাতেই হবে, অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।