সংসদ সদস্যরা কি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন

সম্পাদকীয়

গত শনিবার প্রথম আলোয় একাদশ জাতীয় সংসদের সংসদীয় কমিটিগুলোর যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তাকে হতাশাজনক বললেও কম বলা হয়। জাতীয় সংসদে বর্তমানে ৫০টি কমিটি আছে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি ৩৯টি ও বিষয়ভিত্তিক কমিটি ১১টি। এসব কমিটির প্রতি মাসে একবার বৈঠক করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তারা নিয়মিত বৈঠক করে না, আবার এক দিনে একাধিক বৈঠক করে কোনো কোনো কমিটি নিয়ম রক্ষা করে চলেছে।

জাতীয় সংসদের মেয়াদ ইতিমধ্যে তিন বছর পার হয়েছে। এর মধ্যে করোনাকালে বৈঠক করতে না পারার পক্ষে একটা যুক্ত ছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণের আগে ও সংক্রমণ কমে যাওয়ার পর বৈঠক না করার কী যুক্তি থাকতে পারে?

প্রথম আলো ১০টি সংসদীয় কমিটির গত তিন বছরের ১২৮টি বৈঠকের তথ্য পর্যালোচনা করেছে। এতে দেখা যায়, মন্ত্রণালয় কিংবা বিষয়ভিত্তিক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো নিয়মিত বৈঠক করে না। অনিয়মিতভাবে যেসব বৈঠক হয়, সেখানেও সংসদ সদস্যদের বড় একটি অংশ অনুপস্থিত থাকে।

উল্লিখিত ১২৮টি বৈঠকের মধ্যে মাত্র দুটি বৈঠকে কমিটির সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন। আলোচিত ১০টি কমিটির ১০৫ সদস্যের মধ্যে ৩৬ জনের উপস্থিতি ছিল ৫০ শতাংশের কম। এর অর্থ সংসদীয় কার্যক্রমকে সংসদ সদস্যরাই অগ্রাহ্য করে চলেছেন।

প্রথম আলো যে ১০টি কমিটি পর্যালোচনা করেছে, তার মধ্যে মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত আটটি কমিটি হলো যথাক্রমে স্বরাষ্ট্র; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান; মুক্তিযুদ্ধ; মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়; রেলপথ; যুব ও ক্রীড়া এবং নৌপরিবহন। আর বিষয়ভিত্তিক দুটি কমিটি হলো সরকারি হিসাব এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি।

এর বাইরের কমিটিগুলোর কার্যক্রম ভালো চলছে, বলা যাবে না। ২৩ মে প্রথম আলোর আরেক খবরে বলা হয়, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি, ঈদের আগে বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট ও টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধিতে যখন জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত, তখনো অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি নির্বিকার। পাঁচ মাস পর তারা যে বৈঠক করেছে, সেই বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে অর্থনীতির সংকটের কথা ছিল না। একইভাবে নীরবতা পালন করে চলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও। গত ফেব্রুয়ারি মাসের পর এই কমিটি আর কোনো বৈঠক করেনি।

সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় জাতীয় সংসদের সংসদীয় কমিটিগুলো সরকারের ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করে। সংসদে উত্থাপিত বিলগুলো পর্যালোচনা করা যেমন তাদের দায়িত্ব, তেমনি নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি আদায় করাও। প্রয়োজন মনে করলে তারা যেকোনো বিষয়ে তদন্তও করতে পারে। কিন্তু সংসদীয় কমিটির সদস্যরাই যখন বৈঠক করতে আগ্রহী নন, তখন তাঁরা অন্যের জবাবদিহি আদায় করবেন কীভাবে? এমনও উদাহরণ আছে যে কোনো কোনো সদস্য গত তিন বছরে একবারও কমিটির বৈঠকে হাজির হননি।

পঞ্চম সংসদ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকতেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা। আওয়ামী লীগ সরকার ষষ্ঠ সংসদ থেকে মন্ত্রীর স্থলে সাধারণ সদস্যের এই পদে নিয়োগের রীতি চালু করে। মন্ত্রীকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি রেখে নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি আদায় করা যায় না।

এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের ওই সিদ্ধান্ত সর্বমহলে প্রশংসিতও হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সংসদীয় কার্যক্রম নিয়ে সংসদ সদস্যদেরই কোনো আগ্রহ নেই। তাহলে কি তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন?