সরকারি কর্মকর্তা

সম্পাদকীয়

এখন সরকারি কর্মকর্তাদের নামে-বেনামে যেসব সম্পদ আছে, তার খোঁজ নিলেই বোঝা যাবে, তাঁরা কেন সম্পদের হিসাব দিতে চান না। কথায় বলে, ‘খলের ছলের অভাব হয় না’। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। আওয়ামী লীগ টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও সম্পদের হিসাব তাঁরা দেননি; ব্যতিক্রম ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি হিসাব নিজের ওয়েবসাইটে দিয়ে দিতেন।

মন্ত্রী-সাংসদদের দেখাদেখি হোক কিংবা অভ্যাসের কারণে হোক, সম্পদের হিসাব দিতে অনীহা দেখিয়ে আসছেন সরকারি কর্মকর্তারাও। অথচ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ১১ ধারায় বলা আছে, কোনো সরকারি কর্মচারী তাঁর কর্মস্থল, জেলা বা যে এলাকার জন্য তিনি নিয়োজিত, সেই এলাকায় বসবাসকারী কোনো ব্যক্তির কাছে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি কেনাবেচা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করতে হলে বিভাগীয় প্রধান বা সরকারের অনুমোদন নিতে হবে। অনুমোদন ছাড়া কোনো কর্মচারী কেনাবেচা, দান, উইল বা অন্যভাবে বিদেশে কোনো স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা হস্তান্তর করতে পারবেন না।

২০২০ সালের নভেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, যে তথ্য তাঁরা পেয়েছেন তাতে দেখা যায়, কানাডায় টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারাই এগিয়ে আছেন। রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের স্থান এর পরে। কোথাও মিলেমিশে এবং কোথাও এক পক্ষ আরেক পক্ষের চোখ এড়িয়ে দুর্নীতি করছে এবং বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করছে।

প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দিতে হয়। এরপর পাঁচ বছর অন্তর সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধির বিবরণী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে জমা দেওয়ার নিয়ম। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তারা এনবিআরের দোহাই দিয়ে সম্পদের বিবরণী দেওয়া থেকে বিরত থাকছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত সাত মাসে দুবার চিঠি দিলেও অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীদের একটি অংশের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা বেড়েছে এবং অনেকে নানা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। এ অবস্থায় তাঁদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হলে সম্পদের হিসাব নেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করতে হবে।

গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সচিবালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন বিএসএফ আয়োজিত সেমিনারে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সম্পদের হিসাবও নেওয়া হবে বলে জানিয়েছিলেন। আগের সরকারে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রতিবছর তাঁর আয়ের হিসাব নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা এখন কেন কোনো মন্ত্রী অনুসরণ করতে পারছেন না? আয়ের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে না থাকলে সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে ভয় কিসের?

হিসাব না দেওয়ার প্রশ্নে মন্ত্রী-সাংসদদের মতো আমলারাও এনবিআরের দোহাই দিয়েছেন। এটা অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য। আমরা দেখেছি, এনবিআরে হিসাব দেওয়ার পরও একজন এএসআই কীভাবে স্বপদে বহাল থেকে বেনামে ই–কমার্স ব্যবসায় যুক্ত থাকতে পারেন এবং কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, কানাডায় অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা যদি এগিয়ে থাকেন, তাহলে বোঝা যাচ্ছে এনবিআরে সম্পদের হিসাব দাখিল একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি ও লুটপাট ঠেকাতে পারছে না। চুরি করতে দিয়ে চোর ধরার চেয়ে চুরির পথ বন্ধের চেষ্টা করাই উত্তম। নিয়ম মেনে সম্পদের হিসাব দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের অনীহার মধ্যেই একধরনের অসৎ মানসিকতার প্রমাণ মিলছে। হিসাব দেওয়ার নিয়ম মেনে চলতে সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্য করতে হবে।