সিলেটের দুর্যোগে জাতীয় সংহতি জরুরি

সম্পাদকীয়

অতিভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে আকস্মিক ও স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বড় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সিলেট বিভাগে। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলা এখন কোমর থেকে বুকপানিতে প্লাবিত। সড়ক-রেল যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, মুঠোফোন নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সুনামগঞ্জের পুরোটা এবং সিলেটের অনেক এলাকা কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

হাটবাজার, দোকানপাট, ব্যাংকসহ জনজীবনের স্বাভাবিক সব কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে। হাসপাতালগুলোতেও ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। নৌপথ ছাড়া যোগাযোগের এখন আর কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু নৌকার অপ্রতুলতায় উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা এবং লোকজনের নিরাপদ এলাকায় সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা তৈরি হয়েছে।

বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। শহরাঞ্চলের পরিস্থিতি কিছুটা জানা গেলেও, গ্রামাঞ্চলের বন্যাদুর্গতদের প্রকৃত অবস্থা কী, তা নিয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বন্যার আকস্মিকতা ও ভয়াবহতা এত বিস্তৃত ও ভয়াবহ যে স্থানীয় প্রশাসনকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এর মধ্যে উজানে ভারতের মেঘালয় ও আসামে এবং সিলেট অঞ্চলে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সেটি অব্যাহত থাকবে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। ফলে ভয়াবহ এ দুর্যোগে লাখ লাখ মানুষকে জরুরি ভিত্তিতে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া এবং তাদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জোগানো, চিকিৎসাসেবা প্রদান করা বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, পানিবন্দী মানুষের মধ্যে হাহাকার ও আর্তনাদ চলছে। আশ্রয়ের খোঁজে পানি-স্রোত ভেঙে ছুটছে মানুষ। সবচেয়ে বিপদে আছে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হচ্ছে। যেখানেই শুকনা ও উঁচু জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই আশ্রয় নিচ্ছে মানুষ। সিলেটের সব কটি উপজেলা ও অর্ধেক শহর, সুনামগঞ্জের উপজেলা ও পৌর শহর বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ও সিলেট-ভোলাগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক। দুই জেলায় শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

সুনামগঞ্জের পর সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় সুনামগঞ্জের মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অভাবনীয় সংকট তৈরি হয়েছে।

বন্যাদুর্গত মানুষের সঙ্গে তাদের স্বজনেরা যোগাযোগ করতে না পারায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। উজানের ঢলে আকস্মিক বন্যা দেখা দেওয়ায় কারোরই দুর্যোগ মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। আবার হাটবাজার, দোকানপাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাজার থেকে চাল, ডাল, তেলের মতো নিত্যপণ্য কিনতে পারবে, এমন পরিস্থিতিও নেই। ফলে চলমান দুর্যোগের প্রভাব অনেক গভীর ও বহুমাত্রিক।

এ মুহূর্তেই সচ্ছল-অসচ্ছল বিপুলসংখ্যক মানুষের জরুরি খাদ্যসহায়তা, বিশেষ করে রান্না করা খাবার, চিড়া-গুড়ের মতো শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির প্রয়োজন। উপদ্রুত এলাকায় বিপুল পরিমাণ খাওয়ার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি ও মোমবাতির প্রয়োজন। অসুস্থ ব্যক্তি ও প্রসূতিদের জন্য বিশেষ চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন।

ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে সরকার বন্যাদুর্গত এলাকায় সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী নিয়োগ করেছে। ক্রুজ ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে উদ্ধার তৎপরতা চলছে। সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম চিকিৎসা সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু এত বড় দুর্যোগ মোকাবিলা শুধু সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়।

এ ধরনের দুর্যোগে অতীতে ছাত্র ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্র, সাংস্কৃতিক কর্মী, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠন ও বিত্তবানদের সম্মিলিতভাবে বন্যাদুর্গতদের পাশে এগিয়ে আসতে হবে। এ দুর্যোগ শুধু সিলেটবাসীর একার নয়, সিলেটের মানবিক এ বিপর্যয়ে জাতীয় সংহতি জরুরি।