স্বাস্থ্যসেবার নামে কেন এ অপচয়

সম্পাদকীয়

করোনাকালে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির অভাবে যখন রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে, তখনই বিভিন্ন হাসপাতালে অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী ও অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকার খবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে এ ধরনের বহু নজির আছে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ১৬টি হাসপাতালে ২৮টি রোগনির্ণয় যন্ত্র বাক্সবন্দী হয়ে থাকার খবর ছাপা হয়েছে। বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে থাকা যন্ত্রপাতির মধ্যে আছে ১৩টি এক্স-রে, ছয়টি ভেন্টিলেটর, চারটি আল্ট্রাসনোগ্রাম, একটি ইসিজি, একটি ল্যাপারোস্কপি, একটি কালচার ইনকিউবেটর, একটি হট এয়ার ওভেন ও একটি অটোক্লেভ মেশিন। এ ছাড়া ৩২টি হাসপাতালে ৬৫টি যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে অচল ও অব্যবহৃত পড়ে আছে। এর মধ্যে ২৮টি এক্স-রে, ৯টি আলট্রাসনোগ্রাফি, ৬টি অটোক্লেভ, ৩টি ডায়াথার্মি, ২টি স্টেরিলাইজার, ৫টি অ্যানেসথেসিয়া, ১টি ল্যাপারোস্কপি ও ১টি এমআরআই যন্ত্র অচল অথবা অব্যবহৃত অবস্থায় আছে। ৫টি অ্যাম্বুলেন্সও আছে অচল হয়ে। ব্যবহৃত হচ্ছে না পাঁচটি অস্ত্রোপচারকক্ষও।

করোনার এই সময়ে এক্স-রে, ইসিজি, ভেন্টিলেটর এবং আইসিইউ সরঞ্জাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। করোনার উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের ফুসফুসে সংক্রমণ শনাক্তের জন্য প্রাথমিকভাবে এক্স-রে করা জরুরি। আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর চিকিৎসাসেবার অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্র। এসব যন্ত্র বাক্সবন্দী বা অকেজো অবস্থায় রাখার অর্থ হলো রোগীদের চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করা।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো ২৪ কোটি টাকা দামের অ্যাকসেলেটর মেশিনটি পড়ে আছে দীর্ঘ ৯ বছর ধরে। ২০১৬ সালে এই বাক্সবন্দী যন্ত্র পড়ে থাকার খবর প্রকাশিত হওয়ার পরও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এরপরও পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। যন্ত্রটি একই অবস্থায় আছে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেশিনের জন্য কোনো চাহিদাপত্র দেয়নি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও যন্ত্রটি পাঠায়নি। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমন অবকাঠামো নেই, যেখানে এটি বসানো যেতে পারে। এমন দক্ষ লোকবলও নেই, যাঁরা চালাতে পারবেন।

তাহলে সেখানে যন্ত্রটি কারা পাঠাল, কেন পাঠাল? যেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বারবার চাহিদাপত্র দিয়েও কাঙ্ক্ষিত যন্ত্র পায় না, সেখানে অযাচিতভাবে ২৪ কোটি টাকার যন্ত্র পাঠিয়ে কারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় করেছেন, খুঁজে বের করা প্রয়োজন। বিএমএর মহাসচিব ইহতেশামুল হক চৌধুরী যথার্থই বলেছেন, জবাবদিহি না থাকার কারণেই হাসপাতালের যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে থাকে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনে বাক্সবন্দী কিংবা অকেজো অবস্থায় ফেলে রাখার অসংখ্য উদাহরণ আছে। প্রথম আলোয় খণ্ডিত চিত্রই উঠে এসেছে মাত্র। স্বাস্থ্য বিভাগে কেনাকাটা মানেই কমিশন বাণিজ্য। এর আগে আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের পর্দা কেলেঙ্কারি, করোনা পরীক্ষা কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা দেখেছি। কিন্তু এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত স্বাস্থ্য বিভাগের জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আমরা আশা করব এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী বা অকেজো অবস্থায় ফেলে রাখার প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অন্যথায় স্বাস্থ্য বিভাগে দুর্নীতি-নৈরাজ্য চলতেই থাকবে। দু-একজন চুনোপুঁটির বিরুদ্ধে লোকদেখানো ব্যবস্থা নয়; সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনুন।

স্বাস্থ্যসেবার নামে রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের অর্থের এ অপচয় চলতে পারে না।