‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই।’ গত ১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন আড়াই হাজারের বেশি পদে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় ঘুষ-বাণিজ্যের খবর ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয়। সে সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা খবরটির সত্যতা অস্বীকার করলেও পাঁচ মাস পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেই নিয়োগপ্রক্রিয়া বাতিল করে প্রমাণ করল, প্রথম আলোর প্রতিবেদনই সঠিক ছিল।
করোনাকালে সরকারি হাসপাতালে কারিগরি জনবলের ঘাটতি মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই সব পদে নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল, মৌখিক পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিতে নিয়োগ বোর্ডের এক সদস্যকে ঘুষ ও পদোন্নতির প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন আরেক মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব।
গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও কার্ডিওগ্রাফার পদে নিয়োগের বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করার জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নির্দেশনা দিয়েছেন, যেহেতু তদন্ত প্রতিবেদনে লিখিত পরীক্ষার খাতায় অস্পষ্টতা পাওয়া গেছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে, সেহেতু ওই নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল করে আবার স্বল্প সময়ে নতুন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করা হোক।
আমরা মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে প্রজ্ঞাপনে নিয়োগপ্রক্রিয়া বাতিল করার ক্ষেত্রে ‘লিখিত পরীক্ষার খাতায় অস্পষ্টতা’ পাওয়ার যে ঠুনকো কারণ দেখানো হয়েছে, সেটি সম্পূর্ণ অসত্য। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে দেওয়া চিঠিতে নিয়োগ কমিটির এক সদস্য অভিযোগ করেছিলেন, তাঁকে নগদ এক কোটি টাকা এবং পরে আরও টাকা ও পদোন্নতি দেওয়ার লোভ দেখানো হয়েছে। অতএব, নিয়োগপ্রক্রিয়া বাতিল করাই যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় নয়। যাঁরা এই নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে যাঁরা নিয়োগ কমিটির এক সদস্যকে বিপুল অঙ্কের টাকা উৎকোচ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
আমরাও মনে করি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যাঁরা উৎকোচ নিয়েছেন বা নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিলে ভুল বার্তা যাবে। সবাই ভাববেন, দুর্নীতি করে সহজেই পার পাওয়া যাবে। এই ব্যক্তিরা অন্য কোনো কমিটিতে গিয়ে অন্য কোনো নিয়োগপ্রক্রিয়ায় যে একই কাজ করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী। এ ধরনের ব্যক্তি যত দিন মন্ত্রণালয়ে থাকবেন, তত দিন মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুর্নীতিবাজদের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হবে না। বহুল আলোচিত সাহেদ–কাণ্ডে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকেরও নাম এসেছে।
উল্লিখিত ঘটনার আগে ও পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রথম আলোয় বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে; যার কোনোটির তদন্ত বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এসব দুর্নীতি–অনিয়ম বন্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে, যাঁদের করের অর্থে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হয়ে থাকে।