৬৬ শতাংশ শিক্ষিত বেকার

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা মেটাতে অক্ষম। এ কথা সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্বীকার করলেও সেই শিক্ষাকে কীভাবে যুগোপযোগী করা যায়, সে ব্যাপারে কার্যকর কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। সবকিছুই চলছে গতানুগতিকভাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন সব বিষয় যুক্ত করছে, যার সঙ্গে চাকরির বাজারের বিন্দুমাত্র সংযোগ নেই।

সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছেন। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছেন কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন, এই তথ্য উদ্বেগজনক।

বিআইডিএস দৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ৫৪টি সরকারি ও বেসরকারি কলেজের ২০১৭ সালে অনার্স (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শেষ হওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর মুঠোফোনে জরিপ করে। জরিপে ১ হাজার ৬৩৯ জন শিক্ষার্থী, ২০২ জন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ২৩৩ জন চাকরিজীবীর মতামত নেওয়া হয়। যাঁরা বেকার রয়েছেন, তাঁদের ৬২ শতাংশই ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বাইরে অন্যান্য বিভাগের।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্নাতক শেষ করে চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে তাঁরা শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পান না। মাত্র ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান, তাঁদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি খোঁজার সুবিধা রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী আছেন ২০ লাখের মতো।

প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন, যার উল্লেখযোগ্য অংশ উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তাঁদের সবাই চাকরি পান না। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা চাকরিপ্রার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা তাঁদের চাহিদামতো কাজ পাচ্ছেন না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার, যেখানে ভারতে ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেকার রয়েছেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। আর সমস্যাটি কেবল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নয়। অন্যান্য পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁরা স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন, তাঁদের চাকরির বাজারও ভালো নয়। অন্যদিকে আমাদের শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করছে। এ জন্য বাংলাদেশকে বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে।

সে ক্ষেত্রে আমাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। চাকরির বাজারে যে শিক্ষার চাহিদা নেই, সেই শিক্ষা নিয়ে কী লাভ? উচ্চশিক্ষার নামে এ অপচয় মেনে নেওয়া যায় না। মনে রাখতে হবে, একজন স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীর পেছনে কেবল পরিবারই বিনিয়োগ করে না, রাষ্ট্রেরও বিনিয়োগ থাকে। তাই উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরি মানে রাষ্ট্রেরও বিরাট ক্ষতি।

২০১০ সালে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি করা হয়েছিল। কিন্তু গত ১১ বছরেও তা জাতীয় শিক্ষায় ইতিবাচক ফল এনেছে বলা যাবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো বটেই, পুরো উচ্চশিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।