সাদাপাথর, জাফলংসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে গত এক বছরে কয়েক কোটি ঘনফুট পাথর লুটের ঘটনায় গত মাসে দেশব্যাপী যে আলোড়ন হয়েছিল, তার রেশ পুরোপুরি না কাটতেই সেখানে অবাধে টিলা কাটা হচ্ছে বলে খবর আসছে। নগর ও জেলার অন্তত ৩৪টি স্থানে টিলা কাটার বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। খাদিমপাড়া, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় টিলা ধ্বংসের ভয়ানক চিত্র মিলছে। এসব টিলার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন। বাকিগুলো সরকারি খাসভূমি।
সাদাপাথর এলাকা থেকে মাসের পর মাস প্রকাশ্যে পাথর লুটের খবর বারবার প্রথম আলো প্রকাশ করলেও প্রশাসন সময়মতো গা করেনি। গোটা এলাকার পাথর উজাড় হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠলে সরকার পাথর উদ্ধারে নানা অভিযান চালিয়েছিল। এসব লোকদেখানো অভিযান দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ করেছে।
টিলা কাটার ঘটনা পাথর লুটের ঘটনার দিকেই যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ, প্রতিদিনই প্রকাশ্যে টিলা কেটে মাটি সরিয়ে নেওয়া হলেও তা রোধে প্রশাসনের দিক থেকে দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, এই কর্মকাণ্ডে প্রভাবশালী চক্র জড়িত। খাদিমপাড়া ইউনিয়নের স্থানীয় সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ব্যক্তিমালিকদের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে শ্রমিক নিযুক্ত করে টিলা কেটে সমতল করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা অনুযায়ী, টিলাকাটায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের বেশির ভাগই বিএনপি ও দলটির অঙ্গসংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। এ বিষয়ে কয়েকটি মামলা হলেও তাতে টিলাকাটা থামেনি।
এই লুণ্ঠন শুধু আইন লঙ্ঘন নয়; এটি পরিবেশের ওপর এক দানবীয় হুমকি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬(খ) ধারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়, টিলা বা সমতুল্য ভূখণ্ড কর্তন করতে পারবে না। তথাপি প্রশাসন কার্যত উদাসীন।
পরিবেশবাদী একাধিক সংগঠন জানিয়েছে, ২০২৪ সালের আগের আড়াই দশকে সিলেটে অন্তত ৩০ শতাংশ টিলা সাবাড় হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর প্রশাসন, পুলিশ ও পরিবেশ অধিদপ্তর কয়েক মাস ‘নিষ্ক্রিয়’ ছিল। এ সুযোগে অবাধে টিলা কাটা চলে। এ সময় অন্তত ১৫ শতাংশ টিলার মাটি কমবেশি সাবাড় হয়। ২০২৪ সালের আগে-পরে ৪৫ শতাংশ টিলা পুরোপুরি বা আংশিক সাবাড় হয়েছে। অতীতে এক বছরে যে পরিমাণ টিলা কাটা হয়েছে, গত এক বছরে এর কয়েক গুণ বেশি কাটা হয়েছে। আগে রাতে চুপিসারে টিলা কাটা হতো। এখন দিনের বেলা প্রকাশ্যে চলছে।
টিলা কাটা মানে বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বৃদ্ধি। টিলা কাটার কারণে ভূমিধসে অতীতের অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। হাজার হাজার পরিবারের বসবাস ঝুঁকিতে পড়ছে। সরকারি প্রশাসনের উদাসীনতা ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া সিলেটের টিলাকে নিশ্চিহ্ন করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এ অবস্থায় প্রশাসন ও নাগরিক সমাজকে একত্র হয়ে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ সীমার আইনি শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। টিলার অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিকল্প কর্মসংস্থান ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ সংরক্ষণ পরিকল্পনা প্রণয়ন অপরিহার্য। আইন, প্রশাসন ও নাগরিক দায়িত্ব—এই তিন স্তম্ভ ছাড়া টিলার সুরক্ষা সম্ভব নয়।
আশার কথা, সিলেটের জেলা প্রশাসক সিলেটের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না এবং টিলা কাটায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন। তবে তাঁর বক্তব্যের দৃশ্যমান দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।