আদালতের পর্যবেক্ষণ সরকার আমলে নেবে কি

সম্পাদকীয়

আইনানুযায়ী বহুল আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারির হোতাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে বিচারিক আদালতে। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক আবুল কাসেম গত মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, চেয়ারপারসন জেসমিন ইসলামসহ নয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। যাবজ্জীবন পাওয়া অন্য আসামিরা তানভীরের সহযোগী হিসেবে অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন। এ ছাড়া সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবিরসহ আটজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। উল্লিখিত আইনে এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তানভীর মাহমুদসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় মামলা করে দুদক। এতে আসামিদের বিরুদ্ধে পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের অপব্যবহার, প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তৎকালীন উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান ও বাদী নাজমুচ্ছায়াদাৎ। মামলায় জালিয়াতির মাধ্যমে ৫২৫ কোটি ৬২ লাখ ৯২ হাজার ৮০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে।

মামলার তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) হোটেল শাখা থেকে হল-মার্ক মোট ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। ওই সময় প্রথম আলোতেই হল–মার্ক কেলেঙ্কারির খবর প্রথম ছাপা হলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।

বিলম্বে হলেও অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছেন। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো অপরাধী সম্পর্কে মাননীয় আদালতের প্রণিধানযোগ্য পর্যবেক্ষণ। আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করেন, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত।

হল–মার্ক কেলেঙ্কারির হোতাদের বিচার আর্থিক খাতে দুর্নীতি কমাবে কি না, সেটা নির্ভর করছে সরকারের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। ব্যাংকিং খাতে যদি একের পর এক ঋণ–কেলেঙ্কারি ঘটতে থাকে, তাহলে দু–একটি ঘটনার বিচার পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে না। তদুপরি বিচারিক আদালতে হল–মার্ক কেলেঙ্কারির বিচার শেষ হয়েছে মাত্র। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছেন। অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে অবিলম্বে আপিল নিষ্পত্তি করতে হবে। সরকার রাজনৈতিক মামলার ক্ষেত্রে দ্রুত বিচার আইন ব্যবহার করলেও এ ক্ষেত্রে উদাসীন।

হল–মার্ক কেলেঙ্কারি বাংলাদেশের আর্থিক খাতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলেও একমাত্র নয়। হল–মার্কের আগে ও পরে আরও অনেক ঋণ–কেলেঙ্কারি ঘটেছে। বিশেষ করে আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকতে বেসিক ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলেও তাঁর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

হল–মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু সেই সময় ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের কোনো কোনো সদস্যের ঋণ–কেলেঙ্কারির সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ ছিল। ন্যায়বিচারের স্বার্থে সেটাও খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মনে করি।

ঢাকা বিশেষ জজ আদালত আর্থিক খাতে অনিয়ম ও কেলেঙ্কারি সম্পর্কে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। আদালতের এই বার্তা সরকার কতটা আমলে নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং অর্থ লোপাট বন্ধ করতে সব অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতেই হবে।