সড়ক উন্নয়নের নামে এই গাফিলতির জবাব কী 

আমাদের সড়কগুলো দিনে দিনে ‘যমদূত হয়ে’ উঠেছে। এত দিন আমরা দেখেছি বেপরোয়া যান চালনা কিংবা দুই যানের মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণে দুর্ঘটনায় হরদম মানুষ মারা যায়। এখন দেখা যাচ্ছে চালক ও যাত্রীরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও মৃত্যু যেন অনিবার্য নিয়তি হয়ে পড়েছে। 

গত মঙ্গলবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে তেলবাহী লরি উল্টে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু ও সাতজনের আহত হওয়ার ঘটনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? আর পাঁচজন মানুষের মতো তাঁরাও সড়কে নেমেছিলেন। কারও গন্তব্য ছিল বাজার, উদ্দেশ্য ছিল পণ্য বিক্রি। কারও গন্তব্য ছিল নিজের বাড়ি, উদ্দেশ্য ছিল স্বজনের কাছে যাওয়া। তবে গন্তব্যে যাওয়া হলো না, পথেই আগুনে পুড়লেন তাঁরা। 

প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, একটি জ্বালানি তেলবাহী যান (লরি) উল্টে তেল ছড়িয়ে পড়ে। এতে আশপাশে থাকা দুটি ট্রাক, একটি কাভার্ড ভ্যান ও একটি গাড়িতে (প্রাইভেট কার) আগুন লেগে যায়। ওই সব যানবাহনে থাকা যাত্রী ও পরিবহনশ্রমিকদের ১০ জন পুড়ে যান। জ্বালানি তেলবাহী লরিটি মঙ্গলবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সাভারের জোড়পুল এলাকায় পৌঁছায়। সেখানেই চাকার নিচে ব্লক পড়ে সেটি উল্টে যায়।

মহাসড়কটিতে ইউটার্ন নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। সংস্থাটির ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রকৌশলী সবুজ খান প্রথম আলোকে বলেন, জোড়পুলের ইউটার্ন নির্মাণের কাজটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সেখানে সতর্কতামূলক চিহ্ন দেওয়া এবং আলোর ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি।

এটা কী করে সম্ভব? সড়ক ও জনপথ ঢাকা–সাভার সড়কের মতো অতি ব্যস্ততম পথে এ রকম সংস্কারকাজে সতর্কতামূলক চিহ্ন কিংবা আলোর ব্যবস্থা না রাখা কেবল উদাসীনতা নয়, অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে করি। সওজ কর্মকর্তা তেলবাহী লরির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন দাবি করলেও পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ তা সমর্থন করেননি। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের যেখানে এ ঘটনা ঘটেছে, সেখানে ‘ইউটার্ন’ (যানবাহন ঘোরার জায়গা) বানাতে রাস্তার ওপর সিমেন্ট ও বালুর তৈরি ব্লক রাখা ছিল। তবে কোনো সতর্কতামূলক নির্দেশনা ছিল না।

ইউটার্ন বানানোর স্থানে সড়কের জায়গা কমে যায় কিংবা দূর থেকে ব্লক না দেখা গেলে বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়, সেটাও কি সওজ কর্মকর্তাদের অজানা? এটা রীতিমতো দুর্ঘটনাকে সাদরে ‘আমন্ত্রণ’ জানানো।

অতীতেও সড়ক বিভাগের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে দুর্ঘটনায় অনেককে জীবন হারাতে হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবন কি এতটাই মূল্যহীন যে সড়কে নামলেই তাকে মরতে হবে কিংবা অগ্নিদগ্ধ কিংবা আহত হয়ে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকতে হবে?

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের কোনো অবকাঠামোতে কোনো পরিবর্তন করা হলে আগাম সতর্কতা দেওয়া জরুরি। সেটা করা হলে দুর্ঘটনার দায় সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেই নিতে হবে। যে শিশুটি বাবার সঙ্গে বরগুনা থেকে ঢাকার সাভারে আসছিল, সে এখন আগুনে পুড়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। কী কৈফিয়ত আছে এ রকম মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনার?

এই ঘটনায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ হয়তো নিয়মমাফিক একটি তদন্ত করবে, যার উদ্দেশ্য হবে নিজেদের দায় এড়ানো এবং অন্যের ওপর দায় চাপানো। তেলবাহী লরি উল্টে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হোক। যাদের অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা সরকারেরই দায়িত্ব।