২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল, এটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। অথচ গত চার বছরে এ আইনে যত মামলা হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

অনেক সাংবাদিক এ আইনের শিকার হয়ে এখন কারাগারে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা চলমান। এরই মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৫ ধারায় ২৯টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। 

গত ২১ সেপ্টেম্বর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। তথ্য পরিকাঠামো হলো কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক, যেখানে তথ্য সংরক্ষণ করা। কিন্তু সরকার সেটা না করে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো ঘোষণা করেছে, যা প্রশ্নবিদ্ধ ও বিভ্রান্তিকর।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোতে বেআইনিভাবে প্রবেশ করলে সাত বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। বেআইনিভাবে প্রবেশ করে ক্ষতিসাধন বা ক্ষতির চেষ্টা করলে ১৪ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডই দেওয়া যাবে।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো ঘোষণা করা হলেও ধারণা করা যায়, এর নেপথ্যে আছে প্রশাসনের অনিয়ম-দুর্নীতিকে আড়াল করা। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দুর্নীতি দমন কমিশন সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তার ভিত্তি মূলত গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ। দুদক তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদনে তা স্বীকারও করেছে।

উল্লেখ্য, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, তিতাস গ্যাস, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান আছে। আবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্য খাত, অডিট বিভাগ এ তালিকায় নেই। তাহলে কি সরকার মনে করে এসব প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই?

সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাংবাদিকদের প্রবেশে সরকার নানা রকম বিধিনিষেধ জারি করেছে। এ ধরনের বিধিনিষেধ মানুষের তথ্য পাওয়ার যে মৌলিক অধিকার, তার পরিপন্থী। এতে কেবল গণমাধ্যমই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, জনগণও রাষ্ট্রীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। সরকার তথ্য অধিকার আইন করে জনগণের তথ্য পাওয়ার যে সুযোগ দিয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেই সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আরও সংকুচিত করবে। 

সরকারের এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক সমাজ ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তথ্য ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে, এমন অনেক প্রতিষ্ঠানও। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যেখানে সরকারের সব কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রত্যাশিত, সেখানে এ রকম বিধিনিষেধ আরোপ তাদের দুর্বলতাই প্রকাশ করে।

এ ব্যাপারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা–ও গ্রহণযোগ্য নয়। সাংবাদিক সমাজ শুরু থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা করে আসছে।

সেই আইনের ভিত্তিতে করা পরিকাঠামো ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। কেননা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো তথ্য পরিকাঠামোর প্রজ্ঞাপনটিরও যে নিবর্তনের আরেকটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ কম।