জ্বালানির উৎস নিশ্চিত না করেই বিগত বছরগুলোতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। এতে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় দ্বিগুণ বাড়লেও জ্বালানিসংকটে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রাখার পাশাপাশি কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থার একেবারে গোড়ায় গলদকে সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এর মধ্যেই ৪ অক্টোবর জাতীয় গ্রিডের বিপর্যয় হয়। এতে দেশের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল গ্রিড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের একটা বড় অংশ টানা চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন থাকে। কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ আসতে আট ঘণ্টাও লেগে যায়। জাতীয় গ্রিডের সাম্প্রতিক এই বিপর্যয় সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতাও সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সাম্প্রতিক গ্রিড বিপর্যয়ের পেছনে বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রক্রিয়াটি এখনো স্বয়ংক্রিয় নয়, ফোনে ফোনে নির্দেশনা দিয়ে জাতীয় গ্রিডে চাহিদা ও সরবরাহের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হয়।
এতে কোনো একটা জায়গায় হেরফের হলেই যেকোনো মুহূর্তে বিপর্যয় ঘটতে পারে। তদন্ত কমিটি এবারের বিপর্যয়ের পেছনে মূলত দুটি কারণ চিহ্নিত করছে। প্রথমত, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে সমন্বয়হীনতা। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থার বিধিবদ্ধ নিয়ম (রুল বুক) ও গ্রিড কোড কঠোরভাবে না মানা।
২০১৪ সালের ১ নভেম্বর অনেক বড় বিপর্যয় ঘটেছিল জাতীয় গ্রিডে। সে সময় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় রোধে বিদ্যুৎ সঞ্চালনব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল করা, কারিগরি সব ব্যবস্থার উন্নয়নসহ ৩২ দফা সুপারিশ করেছিল। কিন্তু আট বছর পেরিয়ে গেলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ এ কয়েক বছরে আরও অন্তত তিনবার জাতীয় গ্রিডে ছোট-বড় বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু এত দিনেও কেন সেই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি, তার জবাবদিহি কে করবে?
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জাতীয় গ্রিডে সব সময়ই ছোটখাটো ঘটনা ঘটতে থাকে। একসঙ্গে অনেক ঘটনা ঘটলে তাতে বিপর্যয় ঘটতে পারে। একসময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করত শুধু পিডিবি। এখন অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রও বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এ ছাড়া ভারত থেকে আসা বিদ্যুৎও যুক্ত হয় জাতীয় গ্রিডে। ফলে বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় ও আধুনিক করা না গেলে এ ধরনের বিপর্যয়ের ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণের পথ নেই।
সাম্প্রতিক বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এরই মধ্যে দায়িত্বে অবহেলার কারণে পিজিসিবির দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। একই অভিযোগে অভিযুক্ত বিতরণ কোম্পানির দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করার কাজ চলছে।
জানা যাচ্ছে, সাত-আটজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোনে ফোনে নির্দেশনার প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা কঠিন। প্রশ্ন হলো, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনার মূল সংকট এড়িয়ে কয়েকজনকে শাস্তি দিলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
বিদ্যুৎ খাতের নিরাপত্তার জন্য উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা আধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় করতে হলে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে বর্তমানে বড় যে অপচয়, তা বন্ধ করে সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থায় বিনিয়োগ করা জরুরি করণীয় হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ খাতের অব্যবস্থাপনার পেছনে রয়েছে সরকারে ভুল জ্বালানিনীতি, যার খেসারত প্রতিনিয়ত নাগরিকদেরই দিতে হচ্ছে। বিপর্যয়ের কারণের উৎসের সমাধান না করে কয়েকজনকে বরখাস্ত করে বিদ্যুৎ বিপর্যয় রোধ হবে না।