জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ প্রতিটি অপরাধের বিচার করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেভাবে ইচ্ছেমতো বা ঢালাও মামলা হচ্ছে, তাতে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। হত্যা মামলার বিচার হয় সুষ্ঠু তদন্ত তথা সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আলামতের ভিত্তিতে। অথচ অনেক মামলার আসামি করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চারিতার্থ করতে কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে। এ অবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা করা যায় না।
বুধবার প্রথম আলোয় মামলাসংক্রান্ত দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যার মূল কথা হলো মামলায় এমন অনেক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যার সঙ্গে ঘটনার ন্যূনতম সম্পর্ক নেই। পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতেই এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় দুটি মামলায় আসামিদের তালিকায় আছেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন পরিচালক, একজন উপপরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালক। অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলার পেছনে রয়েছেন বিএনপির একজন নেতা ও তাঁর জামাতা। বিএনপি নেতার জামাতার অনুমোদনহীন হিমাগারে অভিযান চালানোর প্রতিশোধ নিতেই এ মামলা করা হয়েছে। এ মামলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বাদী উত্তর দিয়েছেন, ‘মাঠে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, তখন কোথায় ছিলেন?’ এর অর্থ যাঁরা মাঠে আন্দোলন করেছেন, তাঁদের যা খুশি করার অধিকার আছে, কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। যে দেশে আইনের শাসন আছে, সে দেশে এই ধরনের উক্তি কেউ করতে পারেন না।
ঢাকার মিরপুর মডেল থানাসংলগ্ন মিরপুর শপিং কমপ্লেক্সের সামনে ৫ আগস্ট গুলিতে আহত হয়ে পরে মারা যান রিতা আক্তার। এ ঘটনায় করা মামলায় অন্যদের মধ্যে মিরপুর-১ নম্বরের মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী আফরোজ উদ্দিন ও শাহ আলী থানার ডি ব্লকের বাসিন্দা কাজী জয়নালের নাম রয়েছে। এই দুই ব্যক্তির সঙ্গে ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও কেন মামলা হলো—জানতে চাইলে একটি মামলার বাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির লোকেরা থানায় ছিলেন। তাঁরা আসামির তালিকা ঠিক করেছেন।’
এর মানে ভুক্তভোগীর স্বজন মামলার বাদী হলেও আসামির তালিকা করেছেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা। দলটির অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঘায়েল করতে আসামি করার নজিরও আছে। নজির আছে ঢাকার হত্যা মামলায় কক্সবাজারের বাসিন্দা ও অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসীকে জড়ানোর।
দিনাজপুরের খবরটি আরও উদ্বেগজনক। সেখানে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দিনাজপুরের বিভিন্ন থানায় মারধর, হত্যা, লুটপাট ও চাঁদাবাজির ঘটনায় ১৯টি মামলা হয়। এসব মামলার এজাহারে ৮৫১ জনকে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ৪ হাজার ১৫ জনকে। অভিযোগ আছে, এসব মামলার বাদীরা এজাহারে প্রায় ৪০ জন আসামিকে হলফনামা করে দিয়েছেন ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে; মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি না করার অনুরোধ এসেছে আন্দোলনকারী ছাত্রদের পক্ষ থেকেও। তারপরও ঢালাও মামলা ও হলফনামা–বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। এতে কেবল নিরীহ মানুষই হয়রানির শিকার হচ্ছে না, ন্যায়বিচারের পথও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। কোনো মামলায় যদি দুই শ বা তার চেয়ে বেশি আসামি থাকে, তার তদন্তকাজ শেষ করতে থানা–পুলিশের কত দিন সময় লাগবে?
মামলার নামে এসব অসৎ কর্মকাণ্ড শক্ত হাতে দমন করা হোক।