মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করবে কে

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া যেভাবে ছুটে চলেছে, তাতে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তের জীবনও ওষ্ঠাগত। অনেকে ধারকর্জ করে কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কম কিনে কোনোমতে টিকে আছেন। গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, গত সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।

চাল, ডাল, ডিম, তেল, চিনির দামের ঊর্ধ্বগতির মুখে সাধারণ মানুষের ভরসা ছিল সবজি ও ফলমূল। ফলের দাম মৌসুমে কিছুটা কম থাকলেও এখন চড়া। অন্যদিকে সবজির দাম বেড়েই চলেছে। কোনো সবজি ৭০ টাকার নিচে বিক্রি হয় না। বণিকবার্তা পত্রিকা সবজির উৎপাদন খরচ ও বিক্রয় দামের যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা অবিশ্বাস্য।

সরকারের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এক কেজি বেগুন উৎপাদনে খরচ হয় ১০ টাকার কিছু বেশি। অথচ বিভিন্ন হাত ঘুরে রাজধানীর খুচরা বাজারে সেই সবজি ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ১০ গুণের বেশি দামে। করলা, শসা, মিষ্টিকুমড়া, পটোলসহ অন্যান্য সবজির ক্ষেত্রে কমবেশি এটি সত্য।

ভোক্তা যত বেশি দামেই সবজি কিনুন না কেন, উৎপাদক বা কৃষক ন্যায্য দাম পান না। অস্বাভাবিক পরিবহন ব্যয়, রাস্তায় চাঁদাবাজি, উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিক্রয়কেন্দ্র পর্যন্ত দফায় দফায় আড়তদারি (কমিশন) খরচের কারণে সবজির দাম অস্বাভাবিক হচ্ছে। অক্টোবরের প্রথম দুই সপ্তাহে বৃষ্টি থাকায় আগাম শীতকালীন সবজি আবাদ বিলম্বিত হয়েছে। বৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবজির উৎপাদন। কেবল সবজি নয়, গত কয়েক সপ্তাহে চাল, আটা, মাছ ও মাংসের দামও বাড়তি। আটার ২৪ কেজি বস্তার (১২ প্যাকেট) দাম বেড়েছে ৭০ টাকা।

বাজারের এই অস্থিতিশীলতা রোধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তৎপরতা চোখে পড়ছে না। আগে মন্ত্রী-আমলারা মাঝেমধ্যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আওয়াজ দিলেও এখন নিশ্চুপ। তাহলে তাঁরা কি বাজার সিন্ডিকেটের কাছে হার মানলেন? অর্থনীতিবিদেরা বাজার নিয়ন্ত্রণে বিকল্প নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিকল্প সরবরাহব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু টিসিবি বা অন্যান্য মাধ্যমে সরকার যেসব পণ্য কম দামে বিক্রয় করে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে বাজারে এর কোনো প্রভাবই পড়ছে না।

আমদানি পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দেওয়া হয়। কিন্তু দেশে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে সেটি কেন হবে? ভোক্তাকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে, অথচ উৎপাদক তার সুফল পাচ্ছেন না। মধ্যস্বত্বভোগীরা ফাও খেয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে সরকারের যদি কিছুই করার না থাকে, তাহলে এত সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের কী প্রয়োজন?

কৃষকদের ন্যায্য দাম পাইয়ে দিতে সরকার বিভিন্ন স্থানে কৃষকের বাজার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল, সেখানেও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য লক্ষ করা যাচ্ছে। কৃষকের বাজারে যাঁদের নামে দোকান বরাদ্দ করা হয়েছে, তাঁরা আসলে কৃষক নন। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কথা জোরেশোরে প্রচার করছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত একটি ন্যায্য বাজারব্যবস্থা তৈরি না হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, মন্ত্রী-আমলারা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করবেন কী, সিন্ডিকেটই তঁাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা।

এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হলে বাজার তদারকব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি বিকল্প উপায়ে খাদ্যপণ্য সরবরাহ বাড়ানোর বিকল্প নেই।